জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেল সব, খোলা আকাশের নিচে খায়েরের পরিবার

শূন্য ভিটায় নাতিকে নিয়ে আবুল খায়ের। গত রোববার নোয়াখালীর হাতিয়ার চানন্দি ইউনিয়নের পূর্ব আজিমনগর গ্রামেছবি: প্রথম আলো।

পরনের লুঙ্গি আর গায়ের গেঞ্জি ছাড়া আর কোনো কাপড় নেই আবুল খায়েরের (৬০)। একই অবস্থা তাঁর স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব। কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। ধসে পড়েছে টিনের ঘরটিও। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও অবশিষ্ট নেই। বাধ্য হয়ে এক সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হচ্ছে গোটা পরিবারকে।

শুধু আবুল খায়েরই নন, রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চানন্দি ইউনিয়নের হাজারো গৃহহারা পরিবারের এখন এই অবস্থা। বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারী বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঝড়ের পর সরকারি সহায়তা বলতে পরিবারপ্রতি ১০ কেজি ত্রাণের চাল ছাড়া আর কোনো সাহায্য পাননি বলে জানান তাঁরা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বলেন, তাঁদের এখন খাবারের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মাথা গোঁজার ঠাঁই। বসতঘর না থাকায় দারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তাঁরা।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝড়ের পর প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার দেখা তাঁরা পাননি। চানন্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাহার উদ্দিনের দেখা তাঁরা পান কালেভদ্রে। ঝড়ের পর সরকারি সহায়তা হিসেবে যে ১০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে, তা পরে মেপে দেখেন ৮ কেজি। তা–ও সারা দিন বসিয়ে রেখে ওই চাল দেওয়া হয়েছে। এতে ওই দিনের আয়রোজগার আর কিছুই হয়নি।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে চানন্দি ইউনিয়নের চরনঙ্গলিয়ার রানি গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, শূন্য ভিটার এক পাশে খোলা আকাশের নিচে চৌকির ওপর কান্নারত নাতিকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন আবুল খায়েরের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম। আবুল খায়ের বলেন, চালের জোগাড় হলেও তরকারির জোগাড় হয় না। মেঘনা ভাঙতে ভাঙতে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। যেভাবে ভাঙছে, তাতে আর এক সপ্তাহ পর ঘরের ভিটাও থাকবে না। হঠাৎ করেই জোয়ারের পানিতে ঘরের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাড়িতে গলাসমান পানি হয়েছে।

আবুল খায়ের বলেন, স্থানীয় ভূমিহীন বাজারের গলিতে হলুদ–মরিচ বিক্রি করে সংসার চালাতেন তিনি। এক মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি এক সন্তানসহ তাঁর কাছে থাকেন। পরিবারে ছয়টি মুখ। সাত দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন সবাই। ঘরদুয়ার হারিয়ে কোথায় যাবেন, ভেবে কূল পাচ্ছেন না।

জলোচ্ছ্বাসের সময় ঘরেই ছিলেন ক্ষুদ্র মেকানিক মো. জামসেদ (৩৮)। তিনি বলেন, মুহূর্তের মধ্যে উঁচু হয়ে নদী থেকে পানি এসে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। গাছপালা ধরে রেখে কোনোরকমে জীবন রক্ষা করেছেন। ঘরের জিনিসপত্র, হাঁস–মুরগিসহ সব হারিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোথায় যাবেন, ভেবে কুল পাচ্ছেন না। নিজের ও স্ত্রী-সন্তানদের পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। তিন সন্তান নিয়ে এখন শ্বশুর আবুল খায়েরের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে থাকছেন তিনি।

জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের আঘাতে সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে একই ইউনিয়নের নলেরচরের পূর্ব আজিমনগর গ্রামের নুরুজ্জামানের (৭৪) বসতঘরও। জোয়ারের পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলেন তিনিও। উপায় না দেখে দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে আমগাছ ধরে ছিলেন। বেড়িবাঁধের বাইরে নদীর কূলেই নুরুজ্জামানদের বাড়ি। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম আঘাতেই তাঁর ঘর ধসে পড়ে।

ভাঙাচোরা ঘর শ্রমিক দিয়ে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছেন নুরুজ্জামান। নোয়াখালীর হাতিয়ার চানন্দী ইউনিয়নের পূর্ব আজিমনগর গ্রামে গত রোববার
ছবি: প্রথম আলো।

চানন্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঝড়ে তাঁর ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারী এক হাজারের বেশি বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জোয়ারের পানির তোড়ে বেশির ভাগ মানুষের কাঁচা ঘরের ভিটার মাটি সরে গেছে। তিনি সরকারিভাবে ১১ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। সেগুলো বিতরণ করেছেন। এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ পাননি।

হাতিয়ার (নোয়াখালী-৬ আসন) সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গৃহহারা পরিবারগুলোকে ঘর করে দেওয়ার জন্য টিনসহ অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়ে জোর চেষ্টা করছেন তারা। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন। নিজেও সরাসরি যোগাযোগ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরকারিভাবে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাড়াও দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবায় কাজে লাগানো হচ্ছে।