সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া রিফাতের এখন শ্রমিকের জীবন

একটু বড় হতেই স্কুলের লম্বা ছুটিতে রিফাত চলে যেতে শহরে; করত দিনমজুরের কাজ। এখন সে দুশ্চিন্তায় উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার খরচ নিয়ে। ছবি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর খুলনা কার্যালয়ে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বয়স যখন চার, তখন বাবাকে হারায় রিফাত। এরপর মায়ের সঙ্গে আশ্রয় হয় মামার বাড়িতে। মামাদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। অভাবের লড়াইয়ে তাই সংসারের হাল ধরতে সুন্দরবনের নদীতে রেণু পোনা ধরে বিক্রি করতেন মা। মায়ের স্নেহে বড় হওয়া রিফাতের পড়াশোনাটার হাতেখড়িও মায়ের উপার্জনেই। কিন্তু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মাকে একা ছেড়ে দেয়নি রিফাত। একটু বড় হতেই স্কুলের লম্বা ছুটিতে চলে যেতে শহরে; করত দিনমজুরের কাজ। উপার্জনের টাকা তুলে দিত মায়ের হাতে, খরচ করত নিজের পড়াশোনার জন্য।

রিফাত সানা এবার যশোর বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া রিফাত উচ্চমাধ্যমিকে খরচের কথা ভেবে বেছে নিয়েছে মানবিক বিভাগ। ভর্তি হয়েছে শহরের খুলনা সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে। স্থানীয় একজন ব্যক্তি তাঁকে ভর্তির টাকাটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো বই কেনা হয়নি। অর্থাভাবের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন কীভাবে, সেই দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না রিফাতের।

মা সাহিদা বেগমের সঙ্গে রিফাত এখন থাকে খুলনার দাকোপ উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কালাবগী গ্রামে। ওই গ্রামের কালাবগী সুন্দরবন আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল সে। দাকোপের স্থানীয় একজন সাংবাদিক মেধাবী রিফাতের পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়টি জানালে রিফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। কাগজপত্র নিয়ে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর খুলনা কার্যালয়ে আসে রিফাত। সেখানেই কথা হয় রিফাতের সঙ্গে।

কথা বলে জানা গেল, ছাত্রজীবনই রিফাতের কাছে এখন হয়ে উঠেছে শ্রমিকের জীবনের মতো। খুলনা শহরের বিভিন্ন সড়ক ও নালা নির্মাণের যে কাজ চলছে, বর্তমানে রিফাত একজন ঠিকাদারের হয়ে সেই কাজ করছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢালাই দেওয়া, রড বাঁধার কাজ করে সে। রাতে থাকতে হয় শহরের ফরিদ মোল্লা মোড়ে ঠিকাদারের মালামাল রাখা গুদামঘরে। বাঁশের চেলির ওপর রিফাতসহ সেখানকার আটজন শ্রমিক থাকেন। শ্রমিকদের সঙ্গে মেস করে খাওয়া দাওয়া চলে। দিন চুক্তি উপার্জন। যেদিন কাজ থাকে না সেই দিন আবার বসে থাকতে হয়।

রিফাত জানায়, বয়স যখন চার বছর তখন বাবা তাদের রেখে ভারতে চলে যান। এরপর মা রিফাতকে নিয়ে বাবার বাড়ি কালাবগী চলে যান। নানির সঙ্গে থাকতে শুরু করে তারা। মা নদীতে জাল ধরে রেণু পোনা সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। রিফাত স্কুলে একটু বড় ছুটি হলে বটিয়াঘাটার চক্রাখালীতে তাঁর এক মামার কাছে এসে দিনমজুরের কাজ করত। তবে এসএসসি পরীক্ষার আগের কয়েক মাস সে একটানা পড়াশোনা করেছে। এসএসসিতে ভালো ফলের পর সমস্যা বাঁধে কলেজ ভর্তি হওয়া নিয়ে। পরে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একজনের দেওয়া তিন হাজার টাকায় ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে রিফাত।

কথা বলতে বলতে রিফাত জানায়, ‘এইমাত্র সন্ধ্যায় কাজ শেষ করলাম। এখন কোমর ব্যথা করছে। কাজ করে পড়তে বসতে ঝামেলা হয়ে যায়। পরীক্ষার ফলের পর শহরে আসছি এক মাস। এর মধ্যে আবার ১০ দিন কাজ হয়নি। এই কয় দিনে যা আয় হয়েছে তাতে মা বাড়িতে অসুস্থ হয়েছিল, টাকা পাঠানো লাগছে। বাড়িতে মায়ের খোরাকির জন্য পাঁচ মণ ধান কিনেছি। কলেজের ইউনিফর্ম তৈরি করেছি। বই এখনো কিনতে পারিনি।’

খুলনা সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে এইচএসসির পাঠ চুকিয়ে রিফাত কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়তে চায়। ভালো একজন আইনজীবী বা বিচারক হওয়ার ইচ্ছা তার। কিন্তু আপাতত কলেজে পড়াশোনার খরচ কীভাবে মেটাবে, সেই দুশ্চিন্তা ভর করছে তার মনে। ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বলার সময় রিফাতের চোখেমুখে আগামীর অনিশ্চয়তার শঙ্কা ফুটে ওঠে। রিফাত বলল, ‘সায়েন্সটা ছাড়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু করার তো কিছু নেই। সায়েন্স থেকে এখন আর্টস নেওয়া লাগছে। সারা দিন কাজ করে পড়াশোনা করাটা অনেক কঠিন। আবার কাজ ছাড়লে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। আগামী দিনগুলোয় আমাকে টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য মায়ের নেই। থাকব কীভাবে, খাব কী? এসব চিন্তা করলে ভীষণ খারাপ লাগে।’