হাড়গোড়ের সঙ্গে পাওয়া প্যান্ট দেখে নিখোঁজ ছেলের ‘লাশ’ শনাক্ত করলেন মা

আহাজারি করছেন নাঈমের মা গোলাপী বানু। রোববার বিকেলে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির ধরঞ্জী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

২৩ বছরের তরুণ নাঈম হোসেন প্রায় ৫ মাস আগে বাড়ি থেকে বাজারে গিয়ে নিখোঁজ হন। মা গোলাপী বানু বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও হদিস পাননি। গত শনিবার হঠাৎ গ্রামের একটি বাড়িতে গোসলখানা নির্মাণের জন্য মাটি খননের সময় মানুষের হাড়গোড় বেড়িয়ে আসে। পরে রাত ৯টার দিকে মাথার খুলিসহ বস্তাবন্দী হাড়গোড় উদ্ধার করে পুলিশ। হাড়গোড়ের সঙ্গে থাকা পরনের কাপড় দেখে গোলাপী বানু বলছেন, এগুলো তাঁর ছেলে নাঈম হোসেনের।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী বাজার এলাকায় এ ঘটনায় গতকাল রোববার থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। পরকীয়ার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।

গতকাল বিকেলে নাঈমের নানাবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দরজার সামনে নাঈমের মা গোলাপী বানু বিলাপ করছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

বিলাপ করতে করতে নাঈমের মা বলছিলেন, প্রায় পাঁচ মাস আগে (২২ এপ্রিল) নাঈম বাড়ি থেকে যে প্যান্ট পরে বের হয়েছিলেন, মাথার খুলি ও হাড়গোড়ের সঙ্গে সেই প্যান্ট পাওয়া গেছে। হাত-পা বেঁধে তাঁকে বস্তায় ভরে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। তাঁর কলিজাটাকে কত কষ্ট দিয়ে মেরেছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের তিনি ফাঁসি চান। তিনি আরও বলেন, পুলিশ তৎপর হলে অনেক আগেই নাঈমের লাশ পাওয়া যেত। পুলিশ মোবাইল নম্বর নিয়ে শুধু ঘুরিয়েছে।

স্বজনেরা জানান, ২৩ বছর আগে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীর বাড়ি থেকে এককাপড়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা গোলাপী বানু। বাবার বাড়িতে এসে পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি। নাম রাখেন নাঈম হোসেন। অনেক কষ্টে ছেলেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মায়ের কষ্ট দূর করতে সংসারের হাল ধরেছিলেন নাঈম।

নাঈম হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

নাঈমের মামা অহিদুল ইসলাম বলেন, নাঈমের বাবার নাম মাসুদ রানা। তাঁর বাবার বাড়ি জয়পুরহাট সদর উপজেলার ভুটিয়াপাড়া গ্রামে। তবে নাঈম কোনো দিন সেখানে যাননি। বাবাকেও কোনো দিন দেখেননি। মাসুদও কোনো দিন ছেলের খোঁজ নেননি। নাঈম পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী গ্রামে তাঁর নানাবাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছেন। ক্ষোভ, কষ্ট আর হতাশায় নাঈম নিজের বাবার পরিচয় দিতেন না। তিনি সবাইকে বলতেন, তাঁর বাবা মারা গেছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রেও বাবাকে মৃত দেখিয়েছেন। নাঈমের নিখোঁজের পর তিনি (অহিদুল) থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই জিডিতেও নাঈমের বাবাকে মৃত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাড়গোড় উদ্ধার হয়েছে ধরঞ্জী গ্রামের সামছুল ইসলামের বাড়ি থেকে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সামছুল ইসলাম দুটি বিয়ে করেছেন। তিনি গ্রামের পুরোনো বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। নতুন বাড়িতে প্রথম স্ত্রী রেনুকা এক সন্তান নিয়ে থাকেন। প্রায় এক বছর আগে সামছুল তাঁর নতুন বাড়ি রেজ্জাকুল ওরফে রাজ্জাক নামের বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকার এক ব্যক্তিকে ভাড়া দেন। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে রেজ্জাকুল সেখানে বসবাস করে আসছেন। রেজ্জাকুল ধরঞ্জী গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তির ১০-১৫ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছিলেন। নাঈমের নানাবাড়ি এলাকায় রেজ্জাকুল কলার বাগান করতেন। রেজ্জাকুল ও তাঁর স্ত্রী সেই কলাবাগান পরিচর্যা করতে আসতেন। তখন রেজ্জাকুলের সঙ্গে নাঈমের সখ্য তৈরি হয়। রেজ্জাকুলের ভাড়া বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন নাঈম। এর মাধ্যমে রেজ্জাকুলের স্ত্রীর সঙ্গে নাঈমের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। আর এ ঘটনা থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পাঁচবিবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল হক বলেন, উদ্ধার হওয়া আলামতগুলো নাঈমের বলে তাঁর স্বজনেরা জানিয়েছেন। এরপরও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হতে হবে। এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পরকীয়ার জেরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পুলিশ শুরু থেকেই তৎপর ছিল।