১০ বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ লালমোহন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

২০১২ সালে এখানে অস্ত্রোপচার কক্ষ উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু সার্জারি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচার শুরু করা যায়নি।

ভোলার লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচার কক্ষের দরজায় তালা ঝুলছে। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

ভোলার  লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার কক্ষ উদ্বোধন করা হয়েছে ১১ বছর আগে। কিন্তু সার্জারি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদ নিয়োগ না দেওয়ায় এই হাসপাতালে বড় অস্ত্রোপচার হয় না। শুধু সার্জারিই নয়, এই হাসপাতালে গাইনি, মেডিসিন, শিশুসহ বিশেষজ্ঞের ১১ পদই শূন্য। নার্সসহ কর্মকর্তা–কর্মচারীর সংকটও প্রকট। এক্স–রে যন্ত্রটি ১০ বছর ধরে বিকল। চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটসহ নানা সমস্যায় এখানে এসে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না রোগীরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে এখানে অস্ত্রোপচার কক্ষ (অপারেশন থিয়েটার) উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু সার্জারি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং অবেদনবিদ না থাকায় অস্ত্রোপচার সেবা আর চালু করা সম্ভব হয়নি। কার্যক্রম চালু না থাকায় অস্ত্রোপচার কক্ষে থাকা কোটি টাকার সরঞ্জামও পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

১০ জুন সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিটি ওয়ার্ডের শয্যায় জায়গা না পেয়ে রোগীরা মেঝে ও বারান্দায় বিছানা পেতেছেন। রোগী আসছেন-যাচ্ছেন। এর মধ্যেই  স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংস্কার কাজ চলছে। সকাল ১০টার দিকে নার্সরা রোগীর ব্যবস্থাপত্র দেখে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। ইনজেকশন দিচ্ছেন। কিন্তু চিকিৎসক নেই। তবে বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে কিছু চিকিৎসক আছেন। অস্ত্রোপচার কক্ষের দরজায় বড় তালা ঝুলছে। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি সূত্র জানায়, ২০১২ সালে উদ্বোধনের পর থেকেই অস্ত্রোপচারের কক্ষে তালা দেওয়া। জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও গাইনি বিশেষজ্ঞ ও অবেদনবিদের পদ শূন্য থাকায় সিজারিয়ানসহ সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে।

সরেজমিনে আরও দেখা যায়, হাসপাতালের নতুন ও পুরোনো ভবনে অনেক কক্ষ ও কেবিন খালি পড়ে আছে। অনেকগুলো কক্ষ তালা মারা। অনেক স্থানে মালামাল ফেলে রাখা হয়েছে। 

 লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. মহসিন বলেন, হাসপাতালে সংস্কার কাজ চলার কারণে যত্রতত্র রোগী অবস্থান নিচ্ছেন। তাঁদেরকে সাবধানে ভালো জায়গায় নিতে চাইলে তাঁরা কথা শোনেন না। তা ছাড়া জায়গার সংকট আছে।

■ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। 

■ নার্স, টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য কর্মকর্তা–কর্মচারীর ৫৮টি পদ শূন্য।

■ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে যন্ত্রটি ১০ বছর ধরে বিকল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একটি পুরোনো। পুরোনো ভবনের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে সংস্কারের কাজ চলছে। এ বিষয়ে জেলা স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী রানা দাস বলেন, জায়গার অভাবে সংস্কারকাজ ও রোগীর সেবা এক স্থানে করতে হচ্ছে। তবে জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫০ শয্যার লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। এখানে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞের ১১টি পদ (মেডিসিন, গাইনি, সার্জারি, অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি, চক্ষু, ইএনটি, অবেদনবিদ, শিশু, দন্ত, চর্ম ও যৌন)  শূন্য।

 এ ছাড়া এই হাসপাতালে চিকিৎসা কর্মকর্তার দুটি পদও শূন্য। এখানে এখন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ও ছয়জন চিকিৎসা কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, শুধু যে চিকিৎসকের পদ খালি তা নয়, নার্সের ৩০টি পদের মধ্যে ৭টি পদ শূন্য, এর মধ্যে দুজন প্রেষণে অন্যত্র আছেন। এ ছাড়া অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর তিনটি, উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো) দুটি, সহকারী নার্স একটি, স্বাস্থ্য সহকারী ২৫টি, জুনিয়র মেকানিক একটি, আয়া দুটি, অফিস সহায়ক একটি, মালি একটি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী চারটিসহ ৫৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এখানে জেনারেটর থাকলেও তেলের বরাদ্দ নেই।

কয়েকজন রোগী বলেন, লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো জটিল রোগীর চিকিৎসা নেই বললেই চলে। হাসপাতালের চারপাশ ঘিরে আছে ১০-১১টি বেসরকারি ক্লিনিক আর ডায়গনস্টিক সেন্টার। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এক্স–রেসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। 

লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের দেবীরচর গ্রামের জাকির ব্যাপারী কয়েক দিন আগে তাঁর ডায়রিয়া আক্রান্ত ছেলে জাভেদ মাহমুদকে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়েছেন। তাঁকেও অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁকে হাসপাতালে এসে স্যালাইনসহ প্রায় সব ওষুধই কিনতে হয়েছে। তাতে তাঁর প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

লালমোহন পৌর শহরের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি উপজেলার মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার প্রধান ভরসা। কিন্তু এখানে চিকিৎসকের সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো দূরের কথা, দক্ষ নার্সও নেই। প্রায় এক যুগ ধরে এখানে অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ না থাকার কথা স্বীকার করেছেন লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ৫০ শয্যার হাসপাতালে আবাসিক রোগীর সংখ্যা মাঝেমধ্যে ১০০ ছাড়িয়ে যায়।

আউটডোরে রোগী আসেন প্রতিদিন দুই শতাধিক। মে মাসে আউটডোরে রোগী ছিল ৬ হাজার ৩৬৭। ওষুধ আসে ৫০ শয্যার। সে ওষুধ দ্বিগুণ, তিন গুণ রোগীর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, তাই সব ওষুধ দেওয়া যায় না। আর হাসপাতালে সব রকম ওষুধ নেই।

লালমোহন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান আরও বলেন, প্রতি মাসে ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিকিৎসক, টেকনলজিস্ট, টেকনিশিয়ানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা–কর্মচারীর শূন্য পদ পূরণের জন্য চিঠি পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।