অন্তত ২৫ জন দালাল সক্রিয়

  • হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দৈনিক গড়ে ২৭০ জন ভর্তি থাকে।

  • হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায় ২৫-২৬ জন দালালের তালিকা তৈরি করেছে।

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন দালালেরা। অন্তত ২৫ জন দালাল হাসপাতাল চত্বরে সক্রিয়। তাঁদের বেশির ভাগই নারী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধে প্রশাসনকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, জেলায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের চিকিৎসার অন্যতম ভরসা এই হাসপাতাল। হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১০০টি। শয্যা অনুযায়ী চিকিৎসক দরকার ৪২ জন, কিন্তু বর্তমানে আছেন ১৭ জন। অথচ প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগীকে সেবা দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া দৈনিক গড়ে ২৭০ জন রোগী ভর্তি থাকে।

শহরের প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের এক থেকে তিনজন করে নারী ও পুরুষ দালাল থাকেন হাসপাতালে বলে জানা গেছে।

গত রোববার সকালে দেখা গেছে, হাসপাতালে রোগীদের উপচেপড়া ভিড়। প্রধান ফটকের সামনে অটোরিকশার জটলা। ভেতরে ঢুকতেই টিকিট কাউন্টার, সেখানে লাইন। বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত ৬ জন চিকিৎসক রোগী দেখছিলেন। অন্যদিকে নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বারান্দায় রোগীরা গাদাগাদি করে অপেক্ষায় আছেন। সেখানে দালালেরা ঘোরাফেরা করছেন।

দুপুরে সাদুল্লাপুর উপজেলার মহিষবান্দি গ্রামের মোন্নাফ মিয়া (৪৫) বলেন, চিকিৎসক তাঁকে বুকের এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। চেম্বার থেকে বের হওয়ার পরই অপরিচিত এক যুবক তাঁকে বলেন, ‘এ হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন নেই। আমার সঙ্গে চলেন, কম টাকায় এক্স-রে করে দেব।’ পরে তাঁর সঙ্গে গিয়ে স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৪০০ টাকায় এক্স-রে করান।

হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিউল মজিদ বলেন, হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন আছে। সেটি চার বছর ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। তাই রোগীরা বাইরে থেকে এক্স-রে করান। এ ক্ষেত্রে দালালেরা সুযোগ নিচ্ছেন।

সদর উপজেলার চাপাদহ গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়া (৫০) বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসক তাঁর স্ত্রীকে রক্তের পরীক্ষা করতে পরামর্শ দেন। অপরিচিত এক নারী তাঁদের বলেন, ‘এখানকার পরীক্ষা ভালো হয় না, ভুল রিপোর্ট আসে। সরকারি কাজ বোঝেন তো। আমার সঙ্গে চলেন।’ পরে এক হাজার টাকা নিয়ে বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট ধরিয়ে দেন।

দালালের কথা শুনলেন কেন? প্রশ্ন করলে শাহজাহান বলেন, তাঁরা গ্রামের মানুষ। দালালদের এসব কৌশল তিনি বোঝেননি। হাসপাতালে কম টাকায় পরীক্ষা হতো। বাইরে বেশি টাকা লাগল।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন দালাল বলেন, হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু কী করবেন। তাঁরা গরিব মানুষ। এ কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করে তাঁদের সংসার চলে।

তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাইবান্ধা শহরে ১৫টির বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে। প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক এক থেকে তিনজন করে নারী ও পুরুষ দালাল রেখেছে, যাঁদের প্রতিটি রিপোর্টের বিপরীতে কমিশন দেওয়া হয়। তাঁদের কাজ হাসপাতাল থেকে রোগী আনা।

গাইবান্ধা সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, টাকার লোভে দালালেরা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে রোগীদের বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।

দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধে গত শুক্রবার জেলা শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চ। গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তাদের কাছে সাধারণ রোগীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। লাভবান হচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকেরা। এসব সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট সঠিক হয় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অবিলম্বে এসব বন্ধ করতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন গাইবান্ধা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন মুঠোফোনে বলেন, তাঁদের কোনো প্রতিষ্ঠান এসব দালালির সঙ্গে যুক্ত নয়। দালালেরা রোজগারের জন্য নিজ উদ্যোগে এসব করছেন। দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধে প্রশাসনকে সহায়তা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে গাইবান্ধা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদার রহমান বলেন, দালালদের ধরতে প্রায়ই হাসপাতালে পুলিশ টহল দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশ দেখলেই তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছেন।

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দালালেরা ঘোরাফেরা করেন। তাঁদের অপতৎপরতা রোধ করার জন্য হাসপাতালের সে রকম জনবল নেই। তবে প্রায় ২৫-২৬ জন দালালের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সদর থানাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে র‌্যাব কয়েকজনকে আটক করে জরিমানাও করে। তারপরও দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।