বিচারের অপেক্ষায় ১১ বছর 

৭০ বার অভিযোগপত্র দাখিলের তারিখ পিছিয়েছে। জড়িত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবারের।

তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীছবি: ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ১১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বুধবার (৬ মার্চ)। দীর্ঘ এই সময়ে ৭০ বার তারিখ পেছানোর পরও আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১। সন্তান হত্যার বিচারের অপেক্ষায় থাকা ত্বকীর পরিবার বলছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে না।

একটি হত্যা মামলার বিচার পেতে এত দীর্ঘ সময় লাগা উচিত নয় বলে মনে করেন আলোচিত এই মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৭০টি তারিখ পার হলেও অভিযোগপত্র দাখিল করেনি তদন্তকারী সংস্থা। বিচারে আসামিরা যদি খালাস পান পাবেন, দোষী হলে শাস্তি পাবেন। সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বিচার বন্ধ রাখা রাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক।

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নগরের শায়েস্তা খান সড়কের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ত্বকী। দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে।

সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বিচার বন্ধ রাখারাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক। 
প্রদীপ ঘোষ, বাদীপক্ষের আইনজীবী

হত্যাকাণ্ডের এক বছরে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ ত্বকী হত্যা মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন ও খুনীদের শনাক্ত করার বিষয়টি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বিকে শায়েস্তা করতেই আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছেন। শিগগির আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ১১ বছরেও সেই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়নি। ঝুলে আছে ত্বকী হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া।

ত্বকী হত্যা মামলায় কবে নাগাদ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে, তা জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জে নাগরিক আন্দোলনের নেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসমান পরিবার সরকারের সঙ্গে যুক্ত—এ কারণে বিচার কার্যটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘দেশের বিচারব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারটুকু অবশিষ্ট নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি বিচারের নির্দেশ দেন তাহলে আমরা ত্বকী হত্যার বিচার পাব, নতুবা এই বিচার হবে না।’

ত্বকী হত্যার বিচার চেয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশের ২৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁরা অবিলম্বে ত্বকী হত্যা মামলার বিচার শুরু করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, জেলায় চাঞ্চল্যকর ও রোমহর্ষক মামলা নিষ্পত্তিসংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির ২৫টি মামলার মধ্যে ত্বকী হত্যা তালিকার ১১ নম্বরে। এর মধ্যে ২২টি মামলাই আদালতে বিচারাধীন। তদন্তাধীন দুটি মামলার মধ্যে ত্বকী হত্যা একটি। সবশেষ ২০ ফেব্রুয়ারি এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা।

মনিটরিং কমিটির সদস্য নারায়ণগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি র‌্যাব তদন্ত করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় বদল হওয়ায় অভিযোগপত্র দাখিলে বিলম্ব হচ্ছে। দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিলে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা থেকে সংস্থাটিকে তাগিদ দেওয়া হয়।

ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে ১১ বছর ধরে প্রতি মাসের ৮ তারিখে মোমশিখা প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে আসছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। জোটের সভাপতি জিয়াউল ইসলাম বলেন, দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাম এলেও সেই আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া ও আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল না করা নজিরবিহীন।

দীর্ঘদিন ধরে ত্বকী হত্যা মামলা ঝুলে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি নূরউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, র‌্যাবের প্রস্তুত করে রাখা সেই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হোক, ঘাতকদের বিচার শুরু করা হোক।