ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে অসচ্ছলতা

সিদরাতুল মুনতাহার ও জান্নাতুল মাওয়া দুই বোন। দেড় বছরের ছোট-বড় হলেও পড়ে একই ক্লাসে। জান্নাতুল চায় কৃষিবিদ হতে, আর মুনতাহারের চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার মহুয়া খাতুনও চিকিৎসক হতে চায়। তবে নূপুর খাতুন অন্যদের চেয়ে আলাদা। সে চায় শিক্ষক হতে।

এ চার অদম্য মেধাবী ছাত্রী এবার দেশের চারটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে তাদের মনে আছে সংশয়।

আগ্রহের কমতি নেই দুই বোনের

সিদরাতুল মুনতাহার ও জান্নাতুল মাওয়ার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। বাবার কাজের সূত্রে তাদের বসবাস গাজীপুর সদর উপজেলার শিমুলতলী এলাকায়। তারা তিন বোন; বড় বোনের বিয়ে হয়েছে রাজশাহীতে। বাবা আবদুর রহিম গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ছিলেন। ২০২২ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর মা ফিরোজা আক্তার নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছেন।

পরিবারের সদস্যরা বলেন, ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দুই বোনই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। এরপর দুই বোন ভর্তি হয় গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে। ভালোই চলছিল লেখাপড়া। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বাবার অসুখ ধরা পড়ে। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তবু তারা থামেনি। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দুই বোনই জিপিএ-৫ পেয়েছে।

জান্নাতুল মাওয়া বলে, ‘আমাদের থেকে আমার মায়ের স্বপ্ন বেশি। কোথায় ভর্তি হব, কী করব—এসব নিয়েই মা সব সময় চিন্তা করেন। একসময় প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর চিন্তাটা পাল্টেছি। যেহেতু বাবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন, এ জন্য আমি চাই কৃষি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। হতে চাই কৃষিবিদ। এখন প্রয়োজন সাহস আর অর্থনৈতিক সহায়তার।’

সিদরাতুল মুনতাহার বলে, ‘অসুস্থ অবস্থায় বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলতেন, দেখো ডাক্তাররা কত পরিশ্রম করছে। কিন্তু রোগীর চাপ বেশি। এর পর থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ডাক্তার হব।’

মা ফিরোজা আক্তার বলেন, তাঁর মেয়ে দুজনেই মেধাবী। তাদের বাবা মারা যাওয়ার সময় বলে গেছেন, যত কষ্টই হোক, যেন ওদের লেখাপড়া বন্ধ না হয়। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

অভাবী মায়ের মুখে হাসি

প্রায় ১২ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন আফেলা বেগম। সংসারে অভাব এখনো আছে। কিন্তু মেয়ের পরীক্ষার ভালো ফলের খবর ঘরে খুশি এনেছে। নূপুরদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া এলাকায়।

নূপুর খাতুন বলে, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলেন তার বাবা মো. আবদুল মান্নান। হঠাৎ তিনি মারা যান। তখন তারা খুব ছোট। তখন তার মা ভাই মো. আশিক ও তাকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। খেয়ে না-খেয়ে চলতে থাকে তাদের সংসার। একসময় আশিক সংসারের প্রয়োজনে কাজ শুরু করে। আর সে ধানগড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ- ৪.৮৯ পেয়ে পাস করে। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ধানঘরা উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তার আশা, উচ্চশিক্ষা লাভ করে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার।

ধানগড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. তোফাজ্জল হোসেন খন্দকার বলেন, এমন মেধাবী ছাত্রীর জন্য দরকার একটু সহযোগিতা।

পড়ার খরচ জোগাতে টিউশনি

দেড় শতক জমির ওপর একটা কাঁচা ঘরে চার সদস্যের বসবাস। দিনমজুর বাবা একদিন কাজ না করলে খাবার জোটে না। অসুস্থ ছোট ভাইয়ের চিকিৎসা খরচে তাঁর আয়ের বড় একটা অংশ চলে যায়। কিন্তু মহুয়া খাতুনের পড়াশোনার প্রতি যে প্রবল আগ্রহ। তাই প্রতিবেশী শিশুদের পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জুগিয়েছে। পরিশ্রমের ফল পেয়েছে সে, জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন ভাবনা, কলেজে পড়ার খরচ কীভাবে মেটাবে?

মহুয়া নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার চক গোয়াস গ্রামের ও সালমা বেগম দম্পতির মেয়ে। সে চক গোয়াস বিগুনিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ত।

মহুয়া বলে, বাবা কৃষিজমিতে শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর সামর্থ্য নেই পড়ানোর। টাকার জন্য প্রতিবেশী শিশুদের পড়িয়েছে সে। তবে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেত। উচ্চশিক্ষা নিয়ে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা তার।

চক গোয়াস বিগুনিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আসলাম উদ্দিন বলেন, মহুয়া মেধাবী ছাত্রী। এ কারণে তাঁরা মহুয়াকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। কখনো কখনো আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করেছেন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, মাসুদ রানা, গাজীপুর; মুক্তার হোসেন, নাটোর; সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ]