এনজিও হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা

পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ হবে—এই প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে মাঠকর্মীরা টাকা আনেন।

গ্রাহকেরা তাঁদের জমা রাখা টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে বরসার প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে সাতক্ষীরা শহরেছবি: প্রথম আলো

অধিক মুনাফার দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সাতক্ষীরায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রুরাল অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট (বরসা) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গ্রাহকদের কাছ থেকে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকা ফেরত পাওয়ার দাবিতে গ্রাহকেরা দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলন করলেও কোনো ফল হচ্ছে না।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকায় বরসার প্রধান কার্যালয় চায়না-বাংলা শপিং কমপ্লেক্স ভবনের সামনে হাজারখানেক গ্রাহক অবস্থান নেন। দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুল হক সেখানে এসে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বরাত দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ ঘণ্টা পর গ্রাহকেরা অবস্থান কর্মসূচি তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।

বরসার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই এনজিও একটি ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। তাদের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা, আশাশুনি, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৩টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি গত বছরের প্রথম দিকে চালু করা হয়। বাকি সাতটি পুরোনো শাখা। পুরোনো শাখায় গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে ১৩ হাজার। গ্রাহকদের এসব শাখায় জমা রয়েছে প্রায় সোয়া ৩০০ কোটি টাকা।

গ্রাহকদের দাবি, তাঁরা বরসার ওই সব শাখায় কেউ পাঁচ বছর আগে, আবার কেউ সাত বছর আগে থেকে টাকা জমা রেখেছেন। পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ হবে—এই প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে মাঠকর্মীরা টাকা আনেন। একেকজনের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকেরা মুনাফাসহ বরসার ওই সাতটি শাখায় ৮০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটি টাকা পাবেন।

ধলবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বজল মুখার্জি বলেন, গ্রাহকদের টাকা ফেরত না দিয়ে টালবাহানা করায় তাঁরা গত বছরের ২২ মার্চ বরসার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর শাখা ঘেরাও করেন। ওই বছর ২২ ও ২৩ মার্চ দুই দিন অফিস ঘেরাও করে রাখার পর প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক তিন মাসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করার অঙ্গীকার করে গ্রাহকদের ৭৫ কোটি টাকার চেক দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই চেকে টাকা তোলা যায়নি। তিনি দাবি করেন, ওই শাখার তিন হাজার গ্রাহক কমপক্ষে ১২৫ কোটি টাকা পাবেন।

এই আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন, টাকা না পেয়ে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রাহকেরা ওই শাখার সামনে মানববন্ধন করে তাঁদের টাকা ফেরত চান। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি।

টাকা দিতে সম্পত্তি বিক্রি করবে বরসা

গত বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা শহরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেওয়া আশাশুনির সোদকোনা গ্রামের মিরা বোস বলেন, তিনি জমি বিক্রি করে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হবে এই আশায় সাড়ে ৬ বছর আগে ১২ লাখ টাকা বরসায় জমা রেখেছিলেন। কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে ওই টাকা ফেরত না দিয়ে টালবাহানা করছে। বাধ্য হয়ে অন্যদের সঙ্গে তিনিও বরসার অফিস ঘেরাও করতে এসেছেন।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বরসার নির্বাহী পরিচালক আশিকুর রহমান স্বীকার করেন, তাঁদের সাতক্ষীরা জেলায় সাতটি শাখায় গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে ১৩ হাজারের মতো। গ্রাহকেরা তাঁদের কাছে মূল টাকা পাবেন আনুমানিক সোয়া ৩০০ কোটি টাকা। আশিকুর রহমান বলেন, ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানের মালিক তাঁর বড় ভাই আনিসুর রহমান বিদেশে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ মারা যান। তারপর প্রতিষ্ঠানটি এলোমেলো হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তিনি পত্রিকায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করা হবে মর্মে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি হলে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহম্মাদ হ‌ুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকেরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের জমা করা টাকা ফেরত না পাওয়ায় আন্দোলন করে আসছেন। বিষয়টি তাঁর নজরে আসায় তিনি বরসার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান সিবি হাসপাতাল, চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্স, বরসা রিসোর্ট ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।