‘ইটিপি পড়ে থেকে নষ্ট হবে’

শ্রমিক–কর্মচারীরা বলছেন, ইটিপি এখন পড়ে থাকবে। নষ্ট হয়ে যাবে। এখন মাড়াই বন্ধ, বর্জ্যই নেই।

বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরির অবকাঠামোর পাশে ঝোপ–জঙ্গল জন্মেছে। সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে রংপুর চিনিকলে
ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধায় রংপুর চিনিকলে আখমাড়াই বন্ধ। আড়াই বছরের বেশি সময় উৎপাদন কার্যক্রম নেই। তবুও কারখানার পাশে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপিত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।

চিনিকলের শ্রমিক–কর্মচারীরা বলছেন, সক্ষমতা থাকার পরও চিনিকলে আখমাড়াই শুরু করা হচ্ছে না। উল্টো ইটিপি নির্মাণ করে সরকারের টাকা অপচয় করা হয়েছে। এ ইটিপি এখন পড়ে থাকবে। নষ্ট হয়ে যাবে। এখন মাড়াই বন্ধ, বর্জ্যই নেই। এটা অপরিকল্পিত প্রকল্প। এতে সরকারি টাকা অপচয় হবে।

তবে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মাছুমা আক্তার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, চিনিকলে মাড়াই চালু থাকতেই ২০১৮ সালে সরকার ইটিপি প্রকল্প গ্রহণ করে। চিনিকল বন্ধ হয়নি, মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। তার আগেই ইটিপির বেশিরভাগ কাজ হয়েছে। সম্প্রতি ঠিকাদার চিনিকলের কাছে ইটিপি হস্তান্তর করেছেন।

চিনিকল সূত্র জানায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে ১৯৫৫ সালে চিনিকলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আখমাড়াই শুরু হয় ১৯৫৭ সাল থেকে। টানা ৪৭ বছর চালু থাকার পর ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ চিনিকলটি লে-অফ, পে-অফ ঘোষণা করা হয়। এরপর তিন বছর চিনিকলে মাড়াই বন্ধ থাকে। ২০০৭ সালে পুনরায় মাড়াই শুরু হয়। ১৩ বছর চিনিকলটি ধুঁকে ধুঁকে চলে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর চিনিকলে আখমাড়াই বন্ধ হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, কালক্রমে চিনিকলের ব্যয় বেড়ে যায়। কমে যায় আখের উৎপাদন। ফলে চিনিকলটি লোকসান গুনতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত চিনিকলটি লোকসান দিয়েছে ৫৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চিনিকলের ব্যাংক ঋণ ২৮৮ কোটি টাকা। ঋণের বার্ষিক সুদ দিতে হচ্ছে ১৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া সাত কোটি টাকা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্র্যাচুয়িটি ও বেতন–ভাতা বকেয়া রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয় চিনিকলে ইটিপি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে দেশের ১৪টি চিনিকলে ইটিপি নির্মাণ শুরু হয়। এ কাজের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবিএম ওয়াটার কোম্পানি লিমিটেড। ২০২০ সালের ৩০ জুন নির্মাণকাজের মেয়াদকাল ছিল। কিন্তু তিন বছর পর চিনিকলের কাছে ইটিপি হস্তান্তর করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

রংপুর চিনিকলে ১ হাজার ৯৩৫ দশমিক ৫৪ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে ১ হাজার ৮৫৪ একর জমি (নিজস্ব খামার) সাঁওতালদের দখলে রয়েছে। সেখানে ৭০০ একরের কিছু বেশি জায়গায় ইপিজেট নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে চিনিকল জোন এলাকায় কৃষকদের উদ্যোগে ৩৩৪ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। এই আখ পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ দিকে ২০২০ সালের আগে চিনিকলে ১ হাজার ১০০ জন স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা–কর্মচারী ছিলেন। বর্তমানে আছেন ৮৯ জন। চিনিকলে ১ হাজার ৫০০ মেট্টিক টন আখমাড়াইয়ের সক্ষমতা ছিল। এ পরিমাণ আখমাড়াই করে ১৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, চিনিকলের প্রধানফটক বন্ধ। শুধু ফটকের পাশে ছোট প্রবেশপথ খোলা। কোনমতে একজন মানুষ ঢোকা যায়। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক নিরাপত্তা কর্মীর। কারখানার চারিদিকে ঝোপ–জঙ্গল। আখ বহনকারী অন্তত ৩০টি ট্রলি পড়ে আছে। তবে প্রশাসনিক ভবনের চারদিক পরিচ্ছন্ন। চিনিকলের যেখানে আখ ফেলা হয়, এর কয়েক গজ দূরেই নির্মিত হয়েছে ইটিপি। এটির চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল। পাশেই নিরাপত্তাকর্মীর ছোট্ট একটি ঘর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহিমাগঞ্জ গ্রামের এক কর্মচারী বললেন, ‘গ্র্যাচুয়িটির টাকা না পেয়ে কষ্টে দিন যাপন করছি। কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও বকেয়া পাচ্ছি না।’

রংপুর চিনিকলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) রুহুল আমিন বলেন, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে কারখানার উৎপাদান ক্ষমতা হ্রাস পাবে। কিছু কিছু যন্ত্রপাতির সমস্যা হবে।

রংপুর চিনিকল শ্রমিক কর্মচারি ইউনিয়নের নেতা তবিবর রহমান বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি এখানে এসে ঘোষণা দেন, বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলো আধুনিকায়ন করা হবে। পুনরায় চালু হবে। কিন্তু চালু হওয়া তো দূরের কথা, উপরন্তু বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করে সরকারের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। পরিশোধনাগার করার আগে চিনিকলটি চালু করা উচিত ছিল। মাড়াই না হলে পরিশোধনাগার দিয়ে কি হবে! এটিও পড়ে থেকে নষ্ট হবে।

রংপুর চিনিকল আখচাষি সমিতির সভাপতি জিন্নাত আলী প্রধান বলেন, এখানকার প্রত্যেক কৃষক ১০-১২ একর জমিতে আখ চাষাবাদ করতেন। তাঁরা আখ চাষ করে লাভবান হতেন। সংসারের দায়দেনা মেটাতেন। কিন্তু চিনিকলে মাড়াই বন্ধ। তাই তাঁরা আখ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন।