পাবনায় আওয়ামী লীগে এক নেতার দাপট

দুই ভাগে বিভক্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা। জেলায় বিএনপির পৃথক দুটি কার্যালয় রয়েছে।

উপরের বাঁদিক থেকে শামসুল হক জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ডেপুটি স্পিকার ,গোলাম ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য, শিমুল বিশ্বাস বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী, হাবিবুর রহমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগে ২০০৪ সাল থেকে টানা ১০ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। ২০০৮ সাল থেকে তিনি পাবনা-১ (বেড়া-সাঁথিয়া) আসনের সংসদ সদস্য। বর্তমানে ডেপুটি স্পিকার। নেতা-কর্মীদের দাবি, সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে শামসুল হক নিজ এলাকায় ব্যস্ত। এতে জেলা আওয়ামী লীগে তাঁর প্রভাব কমেছে। প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন সদর আসনের সংসদ সদস্য (পাবনা-৫ আসন) গোলাম ফারুক। দুই মেয়াদে তিনি সাধারণ সম্পাদক ও টানা তিনবারের সংসদ সদস্য।

অন্যদিকে ২০১২ সাল থেকে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ চলছে। ২০১৯ সাল থেকে আহ্বায়ক কমিটি চলেছে চার বছর। দুই ভাগে বিভক্ত নেতা-কর্মীরা। জেলায় বিএনপির পৃথক দুটি কার্যালয় রয়েছে। তবে চলমান এক দফার আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ভুলে এক হতে চাইছেন দলের নেতা-কর্মীরা।

আ.লীগে গোলাম ফারুকের দাপট

২০১৪ সালে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে আসেন গোলাম ফারুক। তিনি সভাপতি হিসেবে পান পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনের সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফকে। ২০২০ সালে শামসুর রহমান প্রয়াত হন। ২০২১ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে রেজাউল রহিম সভাপতি ও গোলাম ফারুক আবার সাধারণ সম্পাদক হন। শামসুর রহমান ছিলেন ঈশ্বরদীর বাসিন্দা। তিনি ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। জেলার রাজনীতি নিয়ে তেমন ভাবতে পারেননি। বর্তমান সভাপতিও সাতপাঁচে জড়ান না। ফলে গোলাম ফারুক এককভাবেই রাজত্ব করেছেন। এ নিয়ে অনেকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়, যা সর্বশেষ পাবনা পৌরসভা নির্বাচনে প্রকাশ্যে আসে।

ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা দলের মনোনীত মেয়র প্রার্থী জেলা যুবলীগের বর্তমান আহ্বায়ক আলী মুর্তজা বিশ্বাসের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বিদ্রোহী প্রার্থী শরীফ উদ্দিন জয়ী হন। আলী মুর্তজার পক্ষে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র কামরুল হাসান। তৃণমূলের বাকি সবাই ছিলেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরীফ উদ্দিনের পক্ষে। জেলা সভাপতি অনেকটা নিশ্চুপ ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কামরুল হাসানসহ অন্তত ১০ জন নেতা প্রার্থী হয়ে গোলাম ফারুকের দুর্গে হানা দিতে চান। এ ছাড়া প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির ছেলে ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য আরশাদ আদনান।  

কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে যেটা হয়েছে, সেটা ভুলে যেতে চাই। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমি একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী।’ আরশাদ আদনান বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে, সেটা বলতে চাই না। আমি আওয়ামী লীগের সবাইকে একটি প্ল্যাটফর্মে এনে কাজ করতে চাই।’

গোলাম ফারুক বলেন, বড় দল, নির্বাচন এলে অনেকে প্রার্থী হতে চাইবেন, এটা স্বাভাবিক। এতে অন্তর্দ্বন্দ্বের মতো মনে হতে পারে, আসলে এটা তেমন কিছু নয়। দলের জন্য যাঁদের ত্যাগ আছে, অবদান আছে, তাঁরাই মনোনয়ন পাবেন। আর মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই মিলেমিশে নৌকার পক্ষে কাজ করবেন।

শামসুর রহমানের মৃত্যুর পর ঈশ্বরদীতে (পাবনা-৪ আসন) মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঘিরে নেতা-কর্মীদের কয়েকটি ধরা তৈরি হয়েছে। তাঁর পরিবার থেকে দুই ছেলে, মেয়ে ও জামাতা পৃথক চারটি বলয় তৈরি করেছেন। বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান বিশ্বাস স্বতন্ত্র ধারায় চলছেন। এই আসনে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম।

বিএনপিতে দুই বলয়

২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি কমিটি হওয়ার পর থেকে বিভক্তি শুরু হয় জেলা বিএনপিতে। ২০১৯ সালে মেয়াদ শেষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে ৪৮ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্র। হাবিবুর রহমান আহ্বায়ক ও সিদ্দিকুর রহমান সদস্যসচিব হন। আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব ছিল ৯০ দিনের মধ্যে ৯ উপজেলা, থানা ও পৌরসভা কমিটি করা। আড়াই বছরে সেসব কমিটি না হওয়ায় শুরু হয় অসন্তোষ। ২০২২ সালে ৪৮ সদস্যের কমিটি ভেঙে আবার ৬ সদস্যর আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়। হাবিবুরই আহ্বায়ক থাকেন। এর এক মাসের মাথায় ওই ৬ সদস্যের কমিটি ভেঙে আবার ৩১ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। হাবিবুর রহমানকে আহ্বায়ক রেখে সদস্যসচিব করা হয় মাসুদ খন্দকারকে।

তিন দফা আহ্বায়ক কমিটি বদল হলেও শেষ হয়নি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া। কয়েকটি উপজেলা কমিটি হলেও সেসব কমিটিতে অভিযোগ রয়েছে ত্যাগীদের বাদ দেওয়ার। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। 

মাসুদ খন্দকার বলেন, ‘একটি পদের জন্য ১০ জনের চাহিদা থাকে। পদ না পেলে একটু মনোমালিন্য হবেই। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এখন আমাদের লক্ষ্য সরকারের পতন।’ 

নেতা-কর্মীদের দাবি, আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান চার বছরে দলের জন্য কিছুই করতে পারেননি। তিনি নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর রাখেন না। কমিটি থেকে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়েছেন। ফলে তাঁরা বঞ্চিত হয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। এতেই জেলা বিএনপিতে দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। 

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সরদার বলেন, হাবিবুর রহমান আওয়ামী লীগ থেকে এসেছেন। তিনি বিএনপির আদর্শ মেনে চলেন না। আর যিনি সদস্যসচিব, তাঁকে কোনো দিন রাজপথের কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায়নি।

হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মূলত করোনার কারণে আমরা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারিনি। প্রক্রিয়া চলমান আছে। নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন।’ 

শিমুল বিশ্বাস বলেন, ‘সবার উচিত, দেশের এই ক্রান্তিকালে মিলেমিশে এক থাকা। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা। দেশের স্বার্থে ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা। আমরা সেটিই করছি।’