সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত

বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা
ছবি: প্রথম আলো

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী নারায়ণমন্দির এবং বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ। বোয়ালখালী পুরাতন বাজার সড়কের এক পাশে মন্দির আর আরেক পাশে মাদ্রাসা। ১৯২১ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ২০০০ সাল থেকে নারায়ণমন্দিরে বিভিন্ন পূজা-পার্বণে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আপ্যায়ন ও খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। আবার মাদ্রাসায় কোনো অনুষ্ঠান হলে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নানাভাবে সহযোগিতা করেন।

২২ বছর ধরে এমন সম্প্রীতির নজির ধরে রেখেছে মন্দির ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। অন্য বছরের মতো এ বছরও শারদীয় দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।

গত রোববার দুপুরে বোয়ালখালী নারায়ণমন্দিরে ঢুকতেই দেখা গেল, পূজার আনুষ্ঠানিকতায় বিরতি চলছে। পরে জানা গেল, তখন সড়কের ওপারের মসজিদে জোহরের নামাজ চলছে। তাই পূজার আনুষ্ঠানিকতায় বিরতি দিয়েছে মন্দির কমিটি। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য মাদ্রাসায় দুপুরের খাবার খেতে গেছেন। মন্দিরে তখন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন আনসার ও ভিডিপির প্লাটুন কমান্ডার আফজাল হোসেন ও প্লাটুন কমান্ডার নিলুফার ইয়াসমিন।

আনসার ও ভিডিপির ওই দুই প্লাটুন কমান্ডার প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর ধরে তাঁরা বিভিন্ন পূজায় এই মন্দিরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এখানে দায়িত্ব পালন করতে এলে তাঁদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে না। খাওয়াদাওয়াসহ যাবতীয় আপ্যায়ন মাদ্রাসা কমিটিই বহন করে।

আলাপের ফাঁকে পুলিশের নায়েক শান্তিমনি চাকমা সেখানে এলেন। তিনি মাদ্রাসা থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরলেন বলে জানা গেল। শান্তিমনি চাকমা বলেন, ‘মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই খাবারদাবারের ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

বোয়ালখালী নারায়ণমন্দির
ছবি: প্রথম আলো

বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশের দুই সদস্য দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। মাদ্রাসার পরিচালক নিজেই তাঁদের আপ্যায়ন করছেন। কিছুক্ষণ পর মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওই মাদ্রাসায় এলেন। পরে মাদ্রাসার পরিচালক ও মন্দির কমিটির সভাপতি দুজনই গল্পগুজবে মেতে উঠলেন।

মন্দির কমিটির সভাপতি মৃদুল কান্তি সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২২ বছর ধরে আমাদের মন্দিরে পূজা-পার্বণ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আপ্যায়নের বিষয়ে আমরা চিন্তামুক্ত থাকি। আপ্যায়ন, খাবারের সব দায়িত্ব মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বহন করে। আবার মাদ্রাসায় কোনো অনুষ্ঠান হলে আমরাও তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করি। মন্দির যেমন আমাদের, তেমনি মাদ্রাসাও আমাদের। আমরা একে অপরের আত্মীয়র চেয়ে বেশি।’

বোয়ালখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ মেহেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোয়ালখালী নারায়ণমন্দির হলো আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের ধর্মের ভিন্নতা থাকলেও আমরা কিন্তু একই সমাজের। প্রতিবেশী হিসেবে প্রতিবেশীকে সাহায্য-সহযোগিতা করা আমাদের একান্ত দায়িত্ব। ২০০০ সাল থেকে আমরা সেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। মন্দির কমিটিও আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকে। আমাদের এ সম্প্রীতির বন্ধন আজীবন অটুট থাকবে।’

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের আর কোথাও এমন সম্প্রীতির নজির আছে কি না, জানি না। তবে বোয়ালখালীতে মন্দির ও মাদ্রাসার সম্প্রীতির এমন নজির ২২ বছর ধরে চলে আসছে। এমন সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত নতুন প্রজন্মের জন্যও উদাহরণ। দীঘিনালা উপজেলার সব এলাকাতেই সব ধর্মের মানুষ সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের মধ্যে বাস করে আসছে।’