উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ২২ কোটি টাকার অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান যশোরের দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য আবেদনও করা হয়েছে।

দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আল-আমিন বলেন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান চলছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের কাগজপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সংস্থাটির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার জন্য দুদক প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকে অভিযোগকারী সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দাবি, দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা ২২ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম–দুর্নীতি করেছে। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য প্রকল্পের স্কুলগুলো যে ভাড়া বাড়িতে পরিচালনা করা হচ্ছিল, সেই বাড়ির মালিকদের বেশির ভাগই ভাড়া পাননি। বেতন–ভাতা বকেয়া রয়েছে অনেক শিক্ষক ও সুপারভাইজারের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক ও ব্যাগ। পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ না দিয়েই তাঁদের বেতন তুলে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়নি প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ। ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক বিবৃতি (স্টেটমেন্ট) দেওয়া হয়েছে, সেটিও নিজেদের তৈরি করা। এসব বিষয় তুলে ধরে তাঁরা দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছেন দুদক যশোর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, পুরো দেশের ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন [(সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫, আউট অব স্কুল চিলড্রেন-(ওওএসসি) প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪)] কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে লিড এনজিও হিসেবে দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থা ছয়টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দিশা সমাজকল্যাণ সংস্থার পরিচালক আরাফাত হাসান বলেন, ২২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ গত বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হয়েছে। প্রকল্প নতুন করে সম্প্রসারণ না হলেও মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প আগের মতোই চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষক মিলে মোট ৭০০ জনের মতো কর্মরত আছেন। অনিয়ম–দুর্নীতির যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। মূলত কয়েকজন শিক্ষক কর্মকর্তা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানী দল চার থেকে পাঁচ দিন তাঁদের সংস্থায় গিয়ে কাগজপত্র পর্যালোচনা করেছেন। তাঁরা মাঠপর্যায়ের সুবিধাভোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে কাজ শেষ করবেন।

অভিযোগকারীদের ভাষ্য, কার্যক্রম শুরুর আগে ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ ভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক ও সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি বেশির ভাগ বাড়ির মালিক। যশোর পৌরসভাসহ ছয়টি উপজেলার ৪৮১টি স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) বেশির ভাগেরই ভাড়া বকেয়া রয়েছে। এই খাতে বকেয়ার পরিমাণ ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। শিক্ষকদের প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও প্রতি মাসে তাঁরা সেই টাকা পাননি। অধিকাংশেরই অর্ধেকের বেশি বেতন বকেয়া।

অভিযোগকারীদের ভাষ্য, সোশ্যাল বেনিফিটের একটি খাতেই ২৪ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর খাতে দুই বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪৮১টি শিখন কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এসব টাকাই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছে বলে দাবি অভিযোগকারীদের।