সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের নামে ‘গাছ হত্যা’

নতুন ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরি করতে গিয়ে গাছ কেটেছে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আন্ধারমানিক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রেছবি: প্রথম আলো

প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরপুর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকদের বেশ আগ্রহ। তাঁদের সেই আগ্রহ মাথায় রেখে সুন্দরবনে নতুন চারটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। আর সে জন্য কাটা হয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক পর্যটক।

বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক এবং খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগীতে চলছে ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরির কার্যক্রম। এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে পায়ে হাঁটার রাস্তা (ফুট-ট্রেইল), ওয়াচ টাওয়ার ও শৌচাগার। চলছে আরও কিছু স্থাপনার কাজ। কয়েকটিতে দেওয়া হয়েছে পর্যটক প্রবেশের অনুমতি।

বন বিভাগ বলছে, নানা সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এসব পর্যটনকেন্দ্র জানান দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনার। এতে একদিকে যেমন বাড়বে রাজস্ব, তেমনি বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যও।

সম্প্রতি সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে নির্মাণাধীন দুটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকদের জন্য স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে নানা প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। যেসব স্থানে পায়ে হাঁটার রাস্তা, ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে, শুধু সেগুলোতেই নয়, কোনো কোনো জায়গায় এসব স্থাপনা থেকে ১৫-১৮ ফুট দূরের বড় বড় গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। কয়েকটি গাছ আংশিক কেটে রাখতেও দেখা গেছে।

সম্প্রতি হবিগঞ্জ থেকে সুন্দরবন ঘুরতে আসা পর্যটক তোফাজ্জেল সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এর আগেও সুন্দরবনে এসেছি। বরাবরই সুন্দরবন খুব ভালো লাগে। আন্ধারমানিক নতুন ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র। তাই সেখানে যাওয়ার আগ্রহটা একটু বেশি ছিল। কিন্তু যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে, তা মন খারাপ করে দিয়েছে। এগুলোকে হত্যাই বলব।’

যেসব স্থানে পায়ে হাঁটার রাস্তা, ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে, শুধু সেগুলোতেই নয়, কোনো কোনো জায়গায় এসব স্থাপনা থেকে ১৫-১৮ ফুট দূরের বড় বড় গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আন্ধারমানিক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের এই পর্যটনকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রবেশের জন্য জেটি দিয়ে উঠতেই বড় খাঁচার মতো তৈরি করে হরিণ ছাড়া হয়েছে। পর্যটকেরা নেমে এ হরিণ দেখে আনন্দ পাচ্ছেন। স্থানটি তৈরিতে সেখানে গাছ কেটে ফাঁকা করা হয়েছে। এর পাশেই বন বিভাগের কার্যালয়। দুই পাশ দিয়ে বনের মধ্যে হাঁটার জন্য তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। এ জন্য কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ। এ রাস্তার দুই পাশে কয়েকটি স্থানে বেশ দূর পর্যন্ত গাছ কেটে নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। কয়েকটি গাছের গোড়ার অর্ধেক অংশ কাটা অবস্থায় দেখা যায়।

একই চিত্র শরণখোলার আলীবান্ধা ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের। অবশ্য সেখানে ফুট-ট্রেইলের কাজ শেষ না হওয়ায় এখনো পর্যটকদের সেভাবে ভ্রমণ অনুমতি দিচ্ছে না বন বিভাগ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্য, একটা অনন্য অসাধারণ সুন্দর জায়গা। কাজেই পর্যটন এখানে বিকাশ লাভ করুক, এটা সবাই চায়। কিন্তু এ শিল্পের বিকাশের নামে ঘোরার স্থান, নানা অবকাঠামো তৈরির মতো যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো এখানে প্রকল্প আকারে গৃহীত হয়, তাতে কংক্রিটের ব্যবহার যত কম থাকবে, এটা তত পরিবেশবান্ধব হবে, তত সুন্দরবনের জন্য ভালো হবে।’

সুন্দরবনের মধ্যে গাছ কাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না মন্তব্য করে শরীফ জামিল বলেন, ‘তার ওপর এখানে যে নকশা করা হয়েছে, পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই পরিবেশবান্ধব নয়। এটা নিঃসন্দেহে দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। এর পরিবর্তন হওয়া দরকার।’ এ জন্য সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সুন্দরবন রক্ষার আলোচনা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে বর্তমানে সাতটি পর্যটন এলাকা আছে। এগুলো হলো করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী, দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট ও কলাগাছিয়া। এসব জায়গায় প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। একই স্থানে বেশি পর্যটকের ভিড়ে বনের সার্বিক পরিবেশ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই ২০২১ সালে নতুন করে আরও চারটি পর্যটন এলাকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ভৌত অবকাঠামোর নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বলা হচ্ছে, এগুলো ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র।

কেন্দ্রগুলো তৈরিতে গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আমরা গাছ কাটি না। আমাদের যে বিদ্যমান ক্যাম্প ও স্টেশনগুলো আছে, সেখানেই মূলতই কেন্দ্রগুলো করা হচ্ছে। সেখানকার যে ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে ফুট-ট্রেইলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করছি। এসব কেন্দ্রে বড় ধরনের কোনো অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে না। এখানে যেন পর্যটকেরা গিয়ে কেবল সীমিত পরিসরে হেঁটে চলে আসতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

এই ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রগুলোর আয়তন পুরো সুন্দরবনের ১ শতাংশ হবে না মন্তব্য করে মিহির কুমার দে বলেন, ‘এর মাধ্যমে স্থানীয়দের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। সেই সঙ্গে বন সম্পর্কে সবার জানার সুযোগ বাড়ছে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। ট্যুরিজমের জন্য সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।’ সুন্দরবনের পর্যটন নীতিমালা হালনাগাদের পরিকল্পনা আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের একটা কার্যক্রম তাঁরা শুরু করেছেন। বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবনের পর্যটন এখনো সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।