ভোলায় কমেছে সবজির উৎপাদন

সবজির চারা বেড়ে ওঠার সময় শৈত্যপ্রবাহ ছিল। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়েছে।

ভোলায় রবি মৌসুমে সবজির ভালো ফলন পাননি কৃষকেরা। কৃষকেরা বলছেন, ঝড়বৃষ্টির কারণে অনেকের সবজিখেত নষ্ট হয়েছে। বাড়তি খরচ করে তাঁরা আবার খেত তৈরি করেন। এদিকে সঠিক সময়ে বীজ না লাগানোর কারণে ফলন ভালো পাননি তাঁরা। ফলে সব ধরনের সবজির ফলন অন্যবারের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। 

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম শাহাবুদ্দিন বলেন, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর ফলন কম হওয়ার প্রধান কারণ প্রতিকূল আবহাওয়া। এ বছর সবজির চারা বেড়ে ওঠার সময়ে (জানুয়ারি মাসে) শৈত্যপ্রবাহ ছিল। যে কারণে চারা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণেও সবজির ফলন কম। 

১৫ দিন ধরে সদর উপজেলার রাজাপুর, ইলিশা, কাচিয়া, ভেলুমিয়া-ভেদুরিয়া ও দৌলতখান উপজেলার মেদুয়া ও মদনপুর ইউনিয়ন ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগাম সবজি উৎপাদনের প্রধান স্থান মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদী তীর ও নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরাঞ্চল। কৃষকেরা সেপ্টেম্বর মাসে জমির চারপাশে মাটির বাঁধ তুলে আগাম সবজির খেত করেন। এর মধ্যে আছে লাউ, চিচিঙা, করলা, ঝিঙা, শসা, ক্যাপসিকাম, মরিচ, ধুন্দুল, টমেটো, ফুলকপি, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, মুলাসহ নানা রকমের সবজি। 

■ সবজির গাছে ফল ও ফুল আসা শুরু করলে দুবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে।  ■ বৃষ্টিতে অধিকাংশ খেত নষ্ট হয় ও দ্বিতীয়বার বীজ বুনে চারা করতে হয়েছে।

কৃষকেরা আরও জানান, এ বছর সবজির গাছে ফল ও ফুল আসা শুরু করলে অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় হামুন এবং নভেম্বরে ‘মিধিলি’ আঘাত হানে। হামুন তেমন ক্ষতি করতে না পারলেও মিধিলির প্রভাবে জোয়ার এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় অধিকাংশ কৃষক ক্ষতির শিকার হন এবং দ্বিতীয়বার বীজ বুনে চারা করতে হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ফলন আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। এতে তাঁরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। 

দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের মধুপুরের কৃষক মো. নিজাম উদ্দিন ফরাজি বলেন, তিনি এ বছর সাড়ে সাত একর জমিতে আগাম সবজির আবাদ করেছেন। মিধিলির সময় জোয়ার ও বৃষ্টিতে খেতের অধিকাংশ গাছ নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় তাঁর প্রায় ১৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া ভালো হওয়ার পর তিনি আবার বীজ বপন করেন। বাইরের জেলা থেকেও চারা সংগ্রহ করতে হয়েছে। 

নিজাম উদ্দিন আরও বলেন, দ্বিতীয়বার নতুন করে চারা লাগিয়ে গাছে ফল আনতে তাঁকে প্রায় দেড় মাস পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। দ্বিতীয়বার লাগানো ক্যাপসিকাম, চিচিঙা ও ঝিঙাগাছে কেবল ফল আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিকে বাজারে সবজির যে দাম ছিল, এখন সে দাম এখন নেই। এখন ফসল বিক্রি করে শুধু ফসল তোলা আর বহনের খরচ ওঠে, লাভের খাতায় যোগ হয় না। 

সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর চরে আট এক জমিতে চিচিঙা, লাউ, করলা, ধুন্দুল ও শসার আবাদ করেছেন কৃষক মাসুদ রানা। তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর এক কেজি বীজ ৬-১০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে কিনেছেন। কিন্তু গত বছরের তুলনায় এ বছর ফলন হয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। ফলনও এসেছে দেরিতে। লাউ আর শসা ছাড়া কোনো সবজির ভালো দাম পাননি তিনি। 

কৃষকেরা আক্ষেপ করে বলেন, এখানকার কৃষকেরা সাধারণত ঢোপে (বড় বস্তা) ভরে ঢাকায় তরকারি পাঠান। তরকারির বস্তা ট্রলারে তুলে লক্ষ্মীপুরে যান। সেখান থেকে ট্রাকে তুলে ঢাকার কারওয়ান বাজার যান। এক ঢোপ (১০০ কেজি) মাল পাঠাতে খরচ হয় ৬০০-৬৫০ টাকা। ফসল তোলা একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। মালের সঙ্গে যাঁকে পাঠান, তাঁর খরচ দুই হাজার টাকা। 

কাচিয়া বারাইপুরের কৃষক মো. ইদ্রিস মাঝি (৫৪) জানান, ‘ঝড়ে আমার পাঁচ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঝড়বৃষ্টিতে যতই ক্ষতি হোক, কেউ খবর নেয় না। কোনো সাহায্য তো দূরের কথা, ঋণও দেয় না।’ 

জেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান ওয়ারেসুল কবির বলেন, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণে শুকনা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু খেতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। এ কারণে খাল খননসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। 

ভোলার কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রাশিদুর হাসান বলেন, ফলন কম হওয়ার প্রধান কারণ জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন। গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। রবি মৌসুম শুরুর সময় বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষকেরা দেরি করে খেত করেছেন। যাঁরা খেত করেছিলেন, তাঁদেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকদের ঝড়বৃষ্টির কারণে একাধিকবার বীজ সংগ্রহ করে নতুন খেত করতে হয়েছে। ফলে সময় নষ্ট হয়েছে। 

মো. রাশিদুর হাসান আরও বলেন, সঠিক সময়ে বীজ না লাগাতে পারলে, ফলনে ভাটা পড়বে। এ ক্ষেত্রে বীজের কর্মক্ষমতা কমে যায়। রবিশস্যের মধ্যে বেশির ভাগ ফসলের সূর্যালোক প্রয়োজন। কিন্তু অসময়ের বৃষ্টির জন্য ফলন কম হয়েছে।