আতঙ্কে ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদছে দুই শিশু

নিহত বিউটির মা ঝর্ণা বেগমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশিরা। গতকাল সকালে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ ইউনিয়নের বার্থা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

প্রতি রাতে বিউটি খাতুনের (৩০) সঙ্গেই ঘুমাত তাঁর চার বছর বয়সী ছেলে। পাশের কক্ষেই ঘুমাত বিউটির ১১ বছর বয়সী মেয়ে। এক রাতের ব্যবধানে যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। মাকে হারিয়ে দুই শিশু এখন নানির কাছে আছে। সারা রাত তাঁরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। কিছু সময় পরপর তারা আতঙ্কে জেগে উঠে ‘মা–মা’ বলে কাঁদছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে রাজবাড়ী সদর উপজেলার বানিবহ ইউনিয়নের বার্থা গ্রাম থেকে বিউটি খাতুনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিউটির পরিবারের অভিযোগ, তাঁর স্বামী লতিফ কাজী কুপিয়ে ও গলা কেটে বিউটিকে হত্যা করেছেন। এ ঘটনার পর থেকে লতিফ কাজী পলাতক। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বাবা বিল্লাল মোল্লা বাদী হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজবাড়ী সদর থানায় মামলা করেছেন।

আরও পড়ুন

নিহত বিউটির মা ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘আমার নাতি বিউটির কাছেই ঘুমাত। আর নাতনি আলাদা ঘরে ঘুমাত। মাসুম বাচ্চা দুটার সামনে মাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর পর থেকে তারা অনেক কান্নাকাটি করেছে। গতকাল রাতে নাতি-নাতনি আমার কাছে ঘুমিয়েছে। কিন্তু তারা ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। কিছু সময় পরপর জেগে উঠেছে। কান্নাকাটি করছে, মা–মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠছে। আবোলতাবোল অনেক কথা বলেছে। সারা রাত এভাবেই কেটেছে।’

ঝর্ণা বেগম দাবি করেন, তাঁর মেয়ের জামাতা লতিফ কাজী প্রায়ই বিউটিকে মারধর করতেন। তবে বিউটি মুখ বুজে সব সহ্য করতেন। মারধর–নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে বিউটি একাধিকবার অভিমান করে বাবার বাড়িতে চলে এসেছিলেন। পরে রাগ কমে গেলে আবার শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতেন।
বিউটির ১১ বছর বয়সী মেয়ে জানায়, রাতে তার মা পোলাও, মুরগির মাংস ও পায়েস রান্না করেছিলেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তারা দুই ভাই-বোন খাওয়া-দাওয়া করে। এরপর সে আলাদা কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ে। মা-বাবার সঙ্গে ছোট ভাই ঘুমাচ্ছিল। রাতে ভাইয়ের কান্নার শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙে। নিজের কক্ষ থেকে বের হয়ে সে দেখতে পায়, মায়ের বুকের ওপর বসে বাবা ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করছেন। সে থামাতে গিয়ে হাতে আঘাত পায়। এরপর দৌড়ে পাশের বাড়ির চাচাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলে। সবাই এসে দেখে, তার বাবা পালিয়ে গেছেন।

১১ বছর বয়সী মেয়ে বলেন, মাকে ছাড়া তাদের ভালো লাগে না। রাতে মায়ের কথা খুব মনে পড়েছে। আগের রাতের কথা মনে করলেই তার খুব ভয় লাগে।

বিউটি খাতুন

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১৪ বছর আগে মহিষবাথান গ্রামের বাসিন্দা বিল্লাল মোল্লার মেয়ের সঙ্গে প্রতিবেশী বার্থা গ্রামের বাসিন্দা মতিয়ার কাজীর ছেলে লতিফ কাজীর সঙ্গে বিয়ে হয়। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে লতিফ তৃতীয়। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে লতিফ ও বিউটি বসবাস করতেন। বিয়ের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ ছিল। প্রায়ই তুচ্ছ ঘটনায় স্ত্রীকে মারধর করা হতো। এ ঘটনায় অনেকবার স্থানীয়ভাবে সালিসও হয়েছে। তবে কোনো সমাধান হয়নি। লতিফ বিভিন্ন রবিশস্যের ব্যবসা করতেন। মৌসুমের সময় শস্য কিনে রেখে দিতেন। পরে ভালো দামে বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।

বানিবহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী লুৎফর রহমান বলেন, তুচ্ছ কারণে লতিফ কাজী তাঁর স্ত্রীকে মারধর করতেন। লতিফের বাবাও তাঁর (লতিফের) মাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মুখে বিষ ঢেলে দিয়েছিল। ওই পরিবারে এটি দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

নিহত বিউটি খাতুনের চাচা বানিবহ ইউপির সদস্য আবদুস সালাম মোল্লা বলেন, ‘ওদের পরিবার ভালো না। এ কারণে আমরা প্রথম দিকে বিয়েতে রাজি ছিলাম না। আমাদের বাড়ির অধিকাংশ সদস্যের বিয়েতে অমত ছিল। কারণ, লতিফের বাবার রেকর্ড ভালো না। অকালে আমাদের ভাতিজিকে হারাতে হলো।’

রাজবাড়ীর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, গতকাল দিবাগত রাতে নিহত গৃহবধূর বাবা বাদী হয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় লতিফ কাজীকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। লতিফ মাদকাসক্ত ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। প্রায়ই তিনি স্ত্রীকে মারধর করতেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ঘটনার পর থেকে লতিফ পলাতক আছেন। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।