রাজশাহীর খাদ্যগুদামে চাল নিয়ে ‘চালবাজি’, কোটি টাকার কারসাজি

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে নিয়মবহির্ভূতভাবে জেলার বাইরে থেকে চাল এনে ঢোকানো হচ্ছে। পাল্টানো হচ্ছে খাওয়ার অনুপযোগী চাল। গতকাল শনিবার সকালে তোলাছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর খাদ্যগুদামে নিম্নমানের ও খাওয়ার অনুপযোগী চাল ঢুকিয়ে পরে তা পাল্টে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এ কাজে জড়িত আছেন গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই। তাঁদের যোগসাজশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গোপনে চাল সরবরাহ ও পাল্টানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল শনিবার সকালে জেলার বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে চাল পাল্টানোর ঘটনা।

নিয়ম অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে তা চুক্তিবদ্ধ মিলারদের মাধ্যমে চাল বানিয়ে সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে, কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ধান না কিনেই সরাসরি নিম্নমানের চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ধান ছাঁটাই, পরিবহন ব্যয়সহ ভালো চালের খরচ দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগসাজশ করে অসাধু কর্মকর্তারা এই অনিয়ম করেছেন।

আরও পড়ুন

৪ সেপ্টেম্বর বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল ইসলাম খাদ্যগুদামে অভিযান চালান। তিনি সেখানে বিপুল পরিমাণ খাওয়ার অনুপযোগী চাল পান এবং তিনটি গুদাম সিলগালা করে দেন। পরে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর আগে ২৬ আগস্ট জেলার দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিনও স্থানীয় খাদ্যগুদামে অভিযান চালিয়ে অনুপযোগী চাল উদ্ধার করেছিলেন। ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই গুদাম থেকে ৮০ মেট্রিক টন চাল সরানো হয়।

দুর্গাপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাগমারার ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে ২০০ মেট্রিক টন চাল দুর্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। সেই চাল খারাপ হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।’

সূত্রমতে, এবার বোরো মৌসুমে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ২ হাজার ৭২৩ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়। ধান থেকে চাল করার জন্য জেলার বিভিন্ন চালকলের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তির তালিকায় আছে—বাগমারার কনক চালকল, আরাফাত চালকল ও ভাই ভাই চালকল, তানোরের আবদুস সাত্তার চালকল, হড়গ্রামের বাদশা রাইস মিল, মোহনপুরের নুরজাহান চালকল, মাহফুজ চালকল ও মোল্লা চালকল। এ আটটি চালকল থেকে ১ হাজার ২১১ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়।

নিয়ম অনুযায়ী নিম্নমানের চাল সরবরাহের জন্য অভিযুক্ত চালকল কালোতালিকাভুক্ত হতে পারে, তাদের লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। নিজ দায়িত্বে নিম্নমানের চাল পাল্টে দেবে তারা।

কোন চালকল থেকে নিম্নমানের চাল সরবরাহ করা হয়েছে—তা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরও অনিয়মের তথ্য। মোহনপুর উপজেলার লালইস গ্রামের মেসার্স মাহফুজুর রহমান চালকলের নামে দেখা যায়, তারা ৪৮০ মেট্রিক টন ধান ভাঙিয়ে ৩১২ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছে। কিন্তু মাহফুজুর রহমান বলেন, তিনি ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে কোনো ধান নেননি। চালও দেননি। তাঁর বাবা মিল চালাতেন। সম্প্রতি বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি দিশাহারা হয়ে গেছেন।

ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে নিয়মবহির্ভূতভাবে জেলার বাইরে থেকে চাল এনে ঢোকানো হচ্ছে। গতকাল শনিবার সকালে বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জে
ছবি: প্রথম আলো

মোহনপুরের কামারপাড়ার মেসার্স নূরজাহান চালকলের নামে ১৮০ মেট্রিক টন ধান ভাঙিয়ে ১১৭ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করার কথা আছে। কিন্তু এই চালকলে গিয়ে কথা হয় স্বত্বাধিকারী ওবায়দুল ইসলামের সঙ্গে। তিনিও বলেন, ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে ধান নেননি। চালও দেননি।

মোহনপুরের হাতুড়িয়া গ্রামের মেসার্স মোল্লা চালকলে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কাজকর্ম নেই। একজন কর্মচারী বসে আছেন। তিনি বললেন, এ বছর বৃষ্টির কারণে কোনো কাজকর্ম নেই। মালিক হারেচ আলী মোল্লা ছিলেন না। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে চাল দিয়েছেন। তবে কত টন দিয়েছিলেন, তা আর বলতে পারেননি।

ভুয়া নামে সরবরাহ

চালকলমালিকদের একটি সূত্র জানায়, মোহনপুর উপজেলার আতাউর রহমানে নামের একজন ব্যবসায়ী খাদ্যগুদামের সঙ্গে যোগসাজশে অন্য মিলের নামে চাল সরবরাহ করেন। নিম্নমানের চাল ধরা পড়ার পর তিনিই এখন চাল বদলে দিচ্ছেন। যোগাযোগ করা হলে গত শুক্রবার সকালে তিনি প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, তাঁর নিজের লাইসেন্স নেই। অন্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সে তিনি ৪২০ মেট্রিক টন ধান নিয়ে চাল করে দিয়েছেন। খারাপ চাল নিয়ে ভালো চাল সরবরাহের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাঁর দেওয়া চাল ভালো ছিল। এখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিছু লাল চাল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ওই চাল সরকারের চাল না। তাই তিনি একটু সহযোগিতা করছেন। মাত্র ১৫ টন ৩০০ কেজি চাল দিয়েছেন।

কিন্তু খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা যায়, রাতের অন্ধকারে গোপনে চাল ঢোকানো হচ্ছে। শনিবার সকালে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে গিয়ে দেখা যায়, একটি ট্রাক চাল নিয়ে ঢুকছে। ট্রাকচালকের হাতে দেওয়া চালের হিসাবপত্রে দেখা যায়, নম্বরটি আতাউর রহমানের। জেরার মুখে চালক স্বীকার করেন, তিনি নওগাঁ থেকে চাল এনেছেন।

নিয়ম অনুযায়ী মিলারের সিলমোহরসহ চালান থাকতে হয়। কিন্তু ওই ট্রাকের বস্তাগুলোতে কোনো সিল ছিল না। অনেক বস্তাই ছোট আকারের।

বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পাশেই বসেছিলেন। বক্তব্য চাইলে তিনি বলেন, তিনি এখন ভারমুক্ত, তিনি কিছু বলতে পারবেন না। অন্য জায়গা থেকে চাল আনা হচ্ছে, তার খরচ কে দিচ্ছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি কিছু দিচ্ছেন, মিলারও দিচ্ছেন।

এই অনিয়মের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাগমারার ইউএনও মাহবুবুল ইসলাম বলেন, তাঁরা একটা বড় প্রতিবেদন দিয়েছেন। এরপর আর তিনি সেখানে যেতে চাইছেন না।

সেখান থেকেই রাজশাহী জেলা খাদ্য কর্মকর্তা (ডিসি ফুড) ওমর ফারুককে ফোন করে এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পরে খোঁজ নিয়ে জানাতে চান। দুপুরের দিকে তিনি বলেন, একটি তদন্ত কমিটি সেখানে কাজ করছে। তারা প্রতিবেদন দেওয়ার আগে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

দুর্গাপুর ও ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে খাওয়ার অনুপযোগী চাল ধরা পড়ার পর জেলার সব খাদ্যগুদামে তদন্ত করার জন্য আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভবানীগঞ্জ ও দুর্গাপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।