‘এক হাতে রিকশা চালাইতে কষ্ট অইলেও সম্মান নিয়া চলতাম পারি’

রিকশায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জসিম মিয়া। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডে জেলা পরিষদ ফটকের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার পথে দ্রুতগামী ট্রাক ধাক্কা দিয়ে তাঁকে রাস্তার ওপর ফেলে দেয়। ডান হাতটি ভেঙে থেঁতলে-মুচড়ে যায়। এরপর কবজি থেকে হাতটাকে কেটে ফেলতে হয়। সেই দুর্ঘটনা শুধু তাঁর শৈশবকেই তছনছ করেনি, স্থায়ী কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

কষ্ট হলেও মো. জসিম মিয়া (৩০) এখন এক হাত দিয়েই সংসারের চাকা সচল রেখেছেন। সকাল থেকে রাত—এক হাতেই রিকশার হাতল ধরে মৌলভীবাজার শহর, শহরের উঁচুনিচু অলিগলিতে ছুটে চলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনি থাকেন মৌলভীবাজার শহরতলির সোনাপুরে। মূল বাড়ি একসময় জেলার কমলগঞ্জে থাকলেও অনেক বছর ধরেই তাঁরা থিতু এই সোনাপুরেই।

৬ নভেম্বর, দিনের আলো নিভে গেছে বেশ আগেই। সড়কবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে কোনো এক ফাঁকে। মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডে বাতি জ্বালিয়ে ছুটে চলছে অসংখ্য যান। কোর্ট রোডের জেলা পরিষদ কার্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়েছিল একটি রিকশা। রিকশার সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন চালক। পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ চোখে পড়ে চালকের ডান হাতটি কবজি থেকে নেই। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে ‘না’ করলেন না।

ডান হাত না থাকায় চাইলেই অনেক কাজ করতে পারেন না জসিম। তবে তিনি মনে করেন, এই অজুহাতে তাঁর বসে থাকারও সুযোগ নেই। সংসার সচল রাখতে রোদ, ঝড়-বৃষ্টিতে প্রতিদিনই তাঁকে পথে নামতে হয়।

জসিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় ডান হাতটি কাটা পড়ার পর থেকে এক হাতেই সব কাজ-কারবার। এর আগে টুকটাক এটা-সেটা করেছেন। তবে প্রায় ৯ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছেন। মৌলভীবাজার শহর, শহরতলিতে রিকশা চালিয়েই তিনি জীবিকার অর্থ জোগান। এক হাতের শক্তিকে ভর করেই সংসারের হাল ধরেছেন। সংসারে মা-বাবা আছেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে দুই বোন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন নবম শ্রেণিতে, একজন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। বাবা গাড়ি চালাতেন। এক দুর্ঘটনায় তাঁরও (বাবার) এক পা, এক হাত অবশ হয়ে গেছে। বড় দুই ভাই সংসার নিয়ে আলাদা থাকেন। আপাতত তাঁকেই সংসারটাকে টেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে।

জসিম মিয়া বলেন, ‘কিছু করার নাই। রিকশা চালাইতে সমস্যা হয়। আপ-ডাউনে বেশি সমস্যা হয়। কিন্তু কিতা করমু (কী করব)। কার কাছে হাত পাতমু (পাতব)। যার কাছে হাত পাতমু, কইব—জোয়ান বেটা কাম করস না কেনে? রিকশা চালাইতে কষ্ট অইলেও (হলেও) মানসম্মান নিয়া চলতাম পারি।’

জসিম মিয়া
ছবি: প্রথম আলো

সকাল ৯টার দিকে রিকশা নিয়ে বের হন জসিম। বেলা দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত রিকশা চালান। এরপর বাসায় চলে যান। খাওয়াদাওয়া করেন। কিছুটা বিশ্রাম নেন। আবার বিকেল পাঁচটার দিকে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এরপর রাত ৯টা পর্যন্ত রিকশা চালান। প্রতিদিন ৭০ টাকা রিকশা ভাড়া দিতে হয়। এরপর আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা থাকে।

জসিম মিয়া বলেন, ‘এই আয় দিয়াই কোনোমতে চলি। বেশি কিছু লাগে না। ডাইল (ডাল)-ভাতের টাকা অইলেই চলে। আইজ রিকশা নষ্ট ছিল। ঠিক করাইয়া বারইতে বারইতে বিকাল অই গেছে। দিনে চালাইতে পারছি না ঠিকই। অখন আইছি। রুজি করমু। বাজার করমু। এরপর বাসাত যাইমু।’

জসিম মিয়া এখনো বিয়ে করেননি। বিয়ের প্রসঙ্গ এলে বলেন, ‘আগে দুই বোনের বিয়া দিমু। এরপর নিজের বিয়া।’

ডান হাত না থাকায় চাইলেই অনেক কাজ করতে পারেন না জসিম। তবে তিনি মনে করেন, এই অজুহাতে তাঁর বসে থাকারও সুযোগ নেই। সংসার সচল রাখতে রোদ, ঝড়-বৃষ্টিতে প্রতিদিনই তাঁকে পথে নামতে হয়। এক হাতে হাতল ধরে প্যাডেলে চাপ দিতে হয়, যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হয়।

রিকশা চালানোর এ কাজে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। নিরুপায় হয়েই এক হাত দিয়ে এই রিকশা চালানোর মতো পেশায় আছেন। তাঁর ইচ্ছা ছোটখাটো হলেও একটা ব্যবসা করার। সামান্য পুঁজি পেলে অন্তত রিকশা-ভ্যানে করে সবজির ব্যবসা করতে পারতেন। অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছেন কিছু পুঁজি জমানোর। কিন্তু এ বাজারে যা আয় করেন, তা থেকে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগই নেই। দিন শেষে হাতে আর কিছুই জমে না। ব্যবসাও সম্ভব হয় না। এক হাতকেই ভরসা করে চলতে হচ্ছে তাঁকে।

জসিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘৮-১০ হাজার টাকা অইলেই (হলেই) অন্তত ভ্যানগাড়িতে সবজির ব্যবসা করতে পারতাম।’ জসিম মিয়া এখনো বিয়ে করেননি। বিয়ের প্রসঙ্গ এলে বলেন, ‘আগে দুই বোনের বিয়া দিমু। এরপর নিজের বিয়া।’