সন্তানের আশায় ওমানের চাকরি ছেড়ে এসেছিলেন, সেই ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কামাল

ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া শিশু নাহিদ তাহিম
ছবি: সংগৃহীত

ছয় চাকার বড় ট্রাক্টর। মাঝের চাকাগুলো চার থেকে পাঁচ ফুট উঁচু। গ্রামের নিরিবিলি মেঠো পথ দিয়ে বালুমহালের এমন ট্রাক্টর যাতায়াত করে দিনভর। রাস্তায় চলাচলের বৈধতা নেই এসব যানের। এমন অবৈধ ট্রাক্টর নিয়ে গ্রামের লোকজনের অভিযোগেরও শেষ ছিল না। তবু কামাল উদ্দিন আর নাসমিন আক্তার দম্পতি কখনোই ভাবেননি সাধারণ এই ট্রাক্টরই তাঁদের জীবন এলোমেলো করে দেবে। গতকাল শনিবার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের হলিপাড়ায় তাঁদের একমাত্র ছেলে চার বছর বয়সী নাহিদ তাহিমকে পিষ্ট করে দিয়ে চলে যায় ট্রাক্টরের চাকা। ছোট্ট তাহিম ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

অনেক সাধনার ধন

১৩ বছর আগে ২০১০ সালে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরমা গ্রামের মেয়ে নাসমিন আকতারের (২৭) বিয়ে হয়েছিল ফটিকছড়ির প্রবাসী মুহাম্মদ কামাল উদ্দিনের (৪৫) সঙ্গে। এরপর প্রতি দুই থেকে তিন বছর পরপর দেশে আসতেন কামাল উদ্দিন। এভাবে কাটে ৯ বছর। এত বছরেও সন্তানের মুখ না দেখায় হতাশ ছিলেন কামাল-নাসমিন দম্পতি। সন্তানের আশায় ২০১৭ সালে ওমান থেকে চাকরি ছেড়ে দেশে চলে আসেন কামাল উদ্দিন। ২০১৮ তাঁদের কোলজুড়ে আসে মেয়ে মেহনাজ নিহা (৫)। পরের বছরেই ছেলে নাহিদ তাহিমের (৪) জন্ম।

সংসারজীবন শুরুর দীর্ঘ এক দশক পর দুই সন্তান জন্ম নেওয়ায় ভীষণ খুশি ছিলেন এই দম্পতি। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের ভাবনা দুজনকে ব্যস্ত রাখত। সন্তানদের কথা ভেবে কামাল উদ্দিন হাত দেন নতুন পাকা ঘর নির্মাণের কাজে। গত বছর বাড়ির কাজ শেষও হয়। এরপর আশা ছিল দুই সন্তানকে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে একসঙ্গে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। কিন্তু তা আর হলো না। ট্রাক্টরের চাকার নিচে চাপা পড়ে গেল এই দম্পতির সুখের স্বপ্ন।

তাহিম কোথাও নেই

আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় ফটিকছড়ির হলিপাড়ায় তাহিমদের বাড়িতে পৌঁছাতেই কানে ভেসে এল কান্নার শব্দ। নতুন পাকা বাড়ির উঠানে প্রতিবেশীদের ভিড়। ঘরভর্তি স্বজনদের একজন জানালেন, তাহিমের মা নাসমিন আকতারকে কোনোভাবেই শান্ত করা যাচ্ছে না। তিনি চিৎকার করে কেঁদেই চলেছেন। কিছুক্ষণ পর তাহিমের নানি মনোয়ারা বেগমের কাঁধে ভর দিয়ে বসার ঘরে এসে বসেন তিনি।

সারা ঘরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে তাহিমের খেলনা, জামাসহ নানা কিছু। জামায় হয়তো তার গন্ধটুকুও লেগে আছে। কিন্তু তাহিম কোথাও নেই। নাসমিন আক্তার হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। পাশে বসে থাকা তাহিমের নানি শক্ত করে মেয়ের হাত ধরে ছিলেন। মেয়ের সঙ্গে কাঁদছিলেন তিনিও।

নাসমিনের মুঠোফোনে তাহিমের একগাদা ছবি। দেখার জন্য নানি মনোয়ারা বেগম মুঠোফোনটি এগিয়ে দেন। একটা ছবিতে দেখা গেল, বড়দের মতো লাল টি–শার্ট, জিনস প্যান্ট আর স্নিকার পরা তাহিমের চুলগুলো ছোট করে ছাটা, চোখে-মুখে রাজ্যের মায়া। মায়াভরা শিশুটির এমন পরিণতি কার পক্ষেই–বা মানা সম্ভব!

আহাজারি থামছে না তাহিমের মা নাসমিন আক্তারের। আজ রোববার দুপুরে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের হলিপাড়ায়
প্রথম আলো

স্বজনেরা জানালেন, বাসা থেকে ৩০০ ফুট দূরে তাহিমের বাবা খেতে কাজ করছিলেন। সেখানে যাওয়ার পথেই ট্রাক্টরটি চাপা দেয় তাহিমকে।

কাঁদতে কাঁদতে তাহিমের মা নাসমিন বলেন, ‘আগামী বছরে দুই ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে স্কুলে ভর্তি করাব বলে পরিকল্পনা ছিল। ওরা কোন স্কুলে যাবে, কোথায় পড়বে—সব ঠিক করে রেখেছিলাম। এখন এসব ভাবতেই মনে হচ্ছে দুনিয়াটা ভেঙে পড়বে।’

আলাপের মাঝখানে তাহিমের বাবা কামাল উদ্দিন ঘরে ঢোকেন। ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করতে থানায় গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চোখে–মুখে বিষাদের ছায়া। কেবল বললেন, ‘থানায় মামলা করেছি। আমরা বিচার চাই।’

বালুমহাল নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ

তাহিমের মৃত্যুর ঘটনায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হলিপাড়ার বাসিন্দারা। ঘটনার পরপরই স্থানীয় গ্রামবাসী ট্রাক্টরচালক মুহাম্মদ ওসমানকে (৩২) আটক করে পুলিশে দেন। পাশাপাশি ওই বালুমহাল বন্ধ করে দিয়ে সড়কের মধ্যে খুঁটি গেড়ে দেয়। তাহিমের জ্যাঠা তাওহিদুল আলম বলেন, অবৈধ গাড়িটির মালিক স্থানীয় ইউপির সাবেক সদস্য মুহাম্মদ বাবুল মিয়া। তাঁর আরও কয়েকটি অবৈধ ট্রাক্টর রয়েছে। যেগুলোর সড়কে চলার কোনো বৈধতা নেই। এসব গাড়ির একেকটি চাকা চার থেকে পাঁচ ফুট উঁচু। গ্রামের ভেতর চললে আরেকটি গাড়ি চলতে পারে না।

স্থানীয় ধুরুং খাল ও লেলাং খালের পারে ওই বালুমহালে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় কৃষক আবুল বশর ও মাহবুব আলমের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এখানে তিনটি বালুমহাল চালান সরকারদলীয় লোকজন। তাঁরা খাল থেকে ইচ্ছেমতো বালু তুলে নেওয়ায় কৃষিজমি ভাঙছে। চাষাবাদেরও ক্ষতি হচ্ছে।

এমন ট্রাক্টরের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় চার বছরের শিশু নাহিদ তাহিমের
সংগৃহীত।

এ ব্যাপারে কাঞ্চননগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিদারুল ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বালুমহালটি সরকারদলীয় স্থানীয় কয়েকজন ইজারা নিয়েছেন। ওই বালুমহালের বালু পরিবহনের সময় ট্রাক্টর চাপায় শিশুটি মারা গেছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে হলিপাড়া গ্রামের সরদার সাহাব উদ্দিন এসে জানান, তাঁরা বিষয়টি আপসের চেষ্টা করছেন। তিনি নিহত শিশু তাহিমের বাবার সঙ্গেও কথা বলতেও নিষেধ করেন।

তবে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাব্বির রাহমান আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, কাঞ্চননগরে কয়েকটি বালুমহাল সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া আছে। আবার অবৈধ বালুমহালও আছে। যে মহালে শিশুটি নিহত হয়, ওই বালুমহাল বৈধ নয় বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বালুমহালে শিশু ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা দুঃখজনক। অবৈধ ট্রাক্টরের গ্রামীণ সড়কে চলাচলের বৈধতা নেই। তাঁরা এ নিয়ে অভিযান চালাবেন।