যে কারাগারে কখনো কোনো কয়েদি থাকেননি
উঁচু দেয়াল আর লোহার মোটা শিকের ফটক দেখেই যে কেউ সহজে বলে দিতে পারবেন, স্থাপনাটি একটি কারাগার। সামনে কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও কয়েদিদের রাখার জন্য কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
চার দশক আগে উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উপকারাগারটি নির্মাণ করেছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু সেখানে এক দিনের জন্যও কোনো কয়েদিকে রাখা হয়নি।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের বাওইজানি গ্রামে এমনই একটি উপকারাগার আছে। দ্রুত নির্মাণকাজ শেষ হলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রকল্পটির কাজ থমকে গেলে কারাগারটি আর চালু হয়নি। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় স্থাপনাটি বর্তমানে ‘ভুতুড়ে বাড়িতে’ পরিণত হয়েছে। স্থাপনাটি দেখভাল করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। সংস্থাটির ভাষ্য, সারা দেশে এমন ২৩টি উপকারাগার আছে।
সমাজসেবা কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদর পর্যন্ত আসামি আনা-নেওয়ার ঝামেলা কমিয়ে স্থানীয় বিচারিক কার্যক্রমকে গতিশীল করতে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার উপকারাগারটি নির্মাণ করে। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে প্রকল্পটির পরবর্তী কার্যক্রম আর আলোর মুখ দেখেনি। উদ্বোধনের আগেই তালা পড়ে যায় ফটকে। ২ দশমিক ৭১ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত উপকারাগার কমপ্লেক্সে পুরুষ কয়েদখানা, নারী কয়েদখানা, রান্নাঘর, কার্যালয় ভবন, নিরাপত্তা প্রহরীদের থাকার জায়গা, পাম্প হাউস ও কর্মকর্তাদের একটি আবাসিক কোয়ার্টার আছে। ২০ জন পুরুষ ও ৫ জন নারী কয়েদির থাকার উপযোগী করে উপকারাগারটি বানানো হয়েছিল।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেল, প্রায় চার দশক আগে নির্মিত স্থাপনার বেশির ভাগের জরাজীর্ণ অবস্থা। ভবনগুলোর পলেস্তারা খসে পড়েছে। দরজা-জানালার কাঠামো নেই। ভবনটি দেখভালের জন্য উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের একজন কর্মচারী আছেন। প্রশান্ত কুমার নামের ওই ব্যক্তি বলেন, উপকারাগারে কর্মকর্তাদের জন্য বানানো কোয়ার্টারে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। ভবনগুলো পরিত্যক্ত হলেও ঝুঁকি নিয়েই থাকছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও পরিবেশের অভাবে এক বছর না পেরোতেই তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৩ সালের পর স্থাপনাটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, সমাজসেবামূলক কোনো কাজে ভবনটি ব্যবহার করা হবে। প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সঠিক পরিকল্পনা ও গুরুত্ব না দেওয়ায় সরকারের কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মিত স্থাপনাটি কোনো কাজে আসেনি বলে ভাষ্য স্থানীয় লোকজনের।
স্থানীয় মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণের পর এক দিনও কাজে না লাগায় স্থাপনাগুলো এখন ধ্বংসের পথে। ভবনের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। ভেতরে জন্ম নিয়েছে ঘন জঙ্গল। দিনের আলোতেই এটাকে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হয়। এভাবে সরকারি সম্পদ নষ্ট হতে দেখে তাঁদের খারাপ লাগে।
মহম্মদপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, স্থানটি অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হলেও সংস্কার ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও জনবল তাঁদের নেই। এটি সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়। এখানে প্রশিক্ষণকেন্দ্র, সংশোধনাগার, সংকটাপন্ন জনগোষ্ঠীর আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যদিও স্থাপনার বেশির ভাগই এখন পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।