কেউ গুলিবিদ্ধ পায়ে, কেউ পেটে, হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তাঁরা
স্ত্রী রুবি আক্তার দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভোগে গত ১০ জুন মারা যান। সেই শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি অসুস্থ এজাজ খান। তার ওপর আরেক যন্ত্রণা ও মানসিক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ছেলে ইয়াস শরীফ খানের (১৭) গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায়। চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে ১৮ জুলাই আহত হয় ইয়াস। এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সে।
আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে আহত আরও ১০ জন এখনো হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে ৮ জনই গুলিবিদ্ধ। ১৬ জুলাই মুরাদপুরে এবং পরে ১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তাঁরা আহত হন। এর মধ্যে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ রয়েছেন। দুই দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছেন।
ইয়াসের বাঁ পায়ে গুলি লেগেছে। চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। কিন্তু সুস্থ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই বাবা এজাজ খানের। এবার এসএসসি পাস করা ইয়াস ১৬ জুলাই উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয় ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে। এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। কিন্তু বাবাকে ফাঁকি দিয়ে দুই দিন পর চলে যায় আন্দোলনে।
দুই ছেলের মধ্যে ইয়াস ছোট। তাঁদের বাসা হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায়। আজ শুক্রবার বাবা এজাজ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফুটবল খেলার কথা বলে চলে যায় আন্দোলনে। আমি জানলে তাকে কোনোভাবেই যেতে দিতাম না। তার মা মারা গেছে আজ ৪৭ দিন। আমি নিজে অসুস্থ। হার্টে রিং পরিয়েছি। এই অবস্থায় মানসিক যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না।’ এর মধ্যে একদিন তাঁকে রক্তও দিতে হয়েছে।
অর্থোপেডিক বিভাগে ইয়াসসহ পাঁচজন এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকিরা হলেন আবুল বাশার (২৬), জয়নাল হক (২০), সুজন (১৪) ও নাজমুল হোসেন (২৪)। তিনজনই গুলিবিদ্ধ।
সুজনের বাঁ পায়ে গুলি লাগে। সে একটি মেসে কাজ করে। সেদিন বাইরে বের হলে চান্দগাঁও এলাকায় পায়ে গুলি লাগে তার। তার মা নুরুন্নাহার হাসপাতালে বলেন, ‘চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট সুজন। গুলি খেয়েছে শুনে হাসপাতালে ছুটে আসি। দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এখন কবে ছেলেকে সুস্থ করতে পারব, তা জানি না।’
চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরও চারজন। তাঁরা হলেন মো. ওসমান (৩৪), আরমান (১৭), আকাশ (১৭) ও মো. রুবেল (২২)। এই চারজনও গুলিতে আহত হন। সুদীপ্ত নামের অপর একজন নিউরো সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন।
ষোলশহর এলাকার দারুত তারবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ওসমান আহত হন ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় মুরাদপুর এলাকায়। ওই দিন পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয় এক পক্ষের। এ সময় ওসমান পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন। ওসমান বলেন, ‘আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় পড়ে যাই। তখন পেটে গুলি লাগে।’
ডেকচি ধোয়ার কাজ করে আরমান। সে বহদ্দারহাটে পেটে গুলিবিদ্ধ হয় ১৮ জুলাই। এর দুই দিন আগে মোটর গ্যারেজের মেকানিক আকাশ মুরাদপুর এলাকায় কাজে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়।
ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন রুবেল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি ১৮ জুলাই চান্দগাঁও শরাফাত উল্লাহ পেট্রলপাম্প এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। রুবেল বলেন, সানোয়ারা আবাসিক এলাকায় তাঁর কিছু শ্রমিক কাজ করছিলেন। তাঁদের মজুরি দেওয়ার জন্য টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পকেটে তখন ৩৬ হাজার টাকা ছিল। সংঘর্ষ শুরু হলে তাঁর পেটে গুলি লাগে। তখনই তিনি মাটিতে পড়ে যান। পরে তাঁকে লোকজন হাসপাতালের উদ্দেশে গাড়িতে তুলে দেন। তখন তাঁর পকেটের টাকা ও মুঠোফোন আর পাননি বলে জানান তিনি।
রুবেল বলেন, ‘আমার এই টাকা শোধ করতে ছয় মাস সময় লাগবে। সুস্থ হয়ে কবে আবার কাজ করতে পারব, তা জানি না।’
তাঁর বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার রোয়াজাহাটে। মা–বাবার সঙ্গে নগরের চান্দগাঁও এলাকায় থাকেন। ছেলে আহত হওয়ার পর থেকে মা হাজেরা বেগম হাসপাতালে রয়েছেন। হাজেরা বলেন, ‘ছেলের চিন্তাই ঘুম হয় না। টাকা গেছে যাক, এখন ছেলেটা পুরোপুরি সুস্থ হলে হয়।’