অধ্যাপক আবদুল ওহাবের সাক্ষাৎকার
সামুদ্রিক মৎস্য চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে, যা এখনই শুরু করা দরকার
অধ্যাপক মো. আবদুল ওহাব খ্যাতনামা মৎস্যবিজ্ঞানী। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ও ডিন ছিলেন। অ্যাকুয়াকালচারের ওপর যুক্তরাজ্যের স্টার্লিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানে এখন পর্যন্ত ২৩ জন পিএইচডি করেছেন। মৎস্য ক্ষেত্রে অসামান্য গবেষণার জন্য তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সিস্টেম থেকে স্বীকৃতি লাভের পাশাপাশি গ্লোবাল রিসার্চ ইমপ্যাকট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন।
আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-অ্যাক্টিভিটির দলনেতা এই বিজ্ঞানী ইলিশ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এতে গত এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকোফিশের দলনেতা হিসেবে কাজ করার পর ৩১ ডিসেম্বর এই দায়িত্ব হস্তান্তর করছেন। সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে।
প্রথম আলো: আপনার নেতৃত্বে ২০১৪ সাল থেকে দেশের মৎস্য খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষত ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
আবদুল ওহাব: দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই একদল মেধাবী বিজ্ঞানী নিয়ে একটি দল গঠন কর ইলিশের মজুত নিরূপণ, মৎস্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করি। মৎস্য অধিদপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে সব পর্যায়ের অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা করে একটি বিশদ কর্মসূচি তৈরি করে কর্মসূচিতে জেলেদের সম্পৃক্ত করে সহব্যবস্থাপনা, হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ এলাকায় ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীতে ষষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, ইলিশের সঠিক প্রজননকাল নির্ধারণ, জাটকা মাছ রক্ষার জন্য জালের ফাঁস নির্ধারণ, জেলেদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে জেলে বধূদের সম্পৃক্তকরণসহ জেলেদের মধ্য থেকে বাছাই করে কমিউনিটি ফিশ গার্ড গঠন ইত্যাদি পদক্ষেপ নিই। ফলে দুই বছরের মধ্যেই সফলতা আসে।
এটাকে টেকসই রূপ দেওয়ার উপায় কী?
আবদুল ওহাব: নির্ধারিত সময়ে মা ইলিশ রক্ষা, আন্তরিকভাবে জাটকা রক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে। একইসঙ্গে জেলে সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখতে তাঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা সংরক্ষণে যথাযথ সংগতিপূর্ণ ইলিশ ব্যবস্থাপনার সংশোধিত কৌশল, যা মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ডফিশ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে প্রণয়ন করেছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে নদ-নদীর পরিবর্তিত গতিপথভিত্তিক অভয়াশ্রম ম্যাপিংসহ দক্ষিণাঞ্চলে নতুন একটি অভয়াশ্রমের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করা জরুরি। পদ্মার ইলিশ রক্ষা ও এর উৎপাদন বাড়াতে নতুন ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের ভেতরের জলাশয়ে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনের হার বেড়েছে ইলিশের কারণে। কিন্তু অন্যান্য মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব?
আবদুল ওহাব: কিছু ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগ করে এটা সম্ভব। বিস্তীর্ণ হাওর ও বড় বিলগুলোতে অভয়াশ্রম সৃষ্টি করা ও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, খাল ও নদীর সংযোগ রক্ষা করা, প্রজনন মৌসুমে দুই মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, সনাতন পদ্ধতিতে দিন করে অনেক মানুষ একসঙ্গে বিলে মাছ ধরার নামে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখা, পোনা মজুতের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা, নদীর বাঁকে অবস্থিত কৌশলগত গভীর স্থান বা কূলগুলোকে স্থায়ী অভয়াশ্রমের আওতায় আনা এবং নদীর পাঙাশ ও ক্যাটফিশের পোনা ধ্বংসকারী অবৈধ চাঁই ব্যবহার নিষিদ্ধ করা গেলে অন্য মাছের উৎপাদন অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব।
এফএও ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) একাধিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাছের উৎপাদন বাড়লেও মোট মজুত কমছে। এটা কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব?
আবদুল ওহাব: এটা ঠিক মাছের উৎপাদন বাড়লেও মুক্ত জলাশয় যেমন নদ-নদী ও সাগরে মাছের মজুত ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। তবে আশার কথা, আমাদের অবস্থা এখনও ভালো। ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম ও সাগরে মাছ আহরণে নির্দিষ্ট সময়ে নিষিদ্ধ রাখার কারণে অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গভীর সাগরে সাগরে বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত ব্যবস্থাপনা কৌশল আমাদের দেশের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
শুধু স্থলজ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে সারা বিশ্বের মানুষকে রক্ষা করা যাবে না। তাই এখন মানবজাতিকে বাঁচাতে সাগরের গুরুত্বের বিষয়টি সামনে এসেছে। আপনিও এ বিষয়ে কাজ করছেন, এটা কতটা বাস্তবসম্মত?
আবদুল ওহাব: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সংকটাপন্ন বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য জোগানোর প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এ জন্য আমাদের সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে মাছ, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক, চিংড়ি-কাঁকড়া উৎপাদন করে নিজস্ব প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। ইকোফিশের মাধ্যমে আমরা জেলে পরিবারকে সম্পৃক্ত করে সি-উইড, সবুজ ঝিনুক ও কোরাল মাছের চাষ শুরু করেছি। শৈবাল ও সবুজ ঝিনুক চাষে সাফল্য পেয়েছি। কোরালসহ অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ মাছ চাষের জন্য পোনার সংকট আছে, তাই পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের সামুদ্রিক মৎস্য চাষের ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
মৎস্যবিজ্ঞানের শিক্ষা সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন, গবেষণা কার্যক্রমে আপনার অনেক অবদান। সেগুলো নিয়ে যদি বলতেন...
আবদুল ওহাব: ব্রিটিশ সরকারি উন্নয়ন সহায়তার (ওডিএ) সঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করে এর মাধ্যমে মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ একটা ভালো ফল দিয়েছে। নানা উদ্যোগ আমাদের মৎস্য খাতে একটি পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী ও অনুসন্ধিৎসু প্রজন্ম উপহার দিয়েছে; যাঁরা দেশের মৎস্য খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং দেবে।
ইকোফিশ থেকে অবসরে যাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে যদি কিছু বলুন?
আবদুল ওহাব: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় জলজ জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, নদ-নদী ও সামুদ্রিক জলজ সম্পদ উন্নয়নে কাজ করতে চাই। দেশের মেধাবী শিক্ষক ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজটি এগিয়ে নিতে চাই।