নেত্রকোনার হাওর এখনো পানিশূন্য কেন

বছরের এ সময়ে নেত্রকোনার হাওরগুলো পানিতে ভরপুর থাকার কথা থাকলেও এখন সব কটি হাওরই প্রায় পানিশূন্য। রোববার দুপুরে মদন উপজেলার উচিতপুরেছবি: প্রথম আলো

হাওরের বেশির ভাগ গল্পই পানির। বছরের প্রায় সাত মাস থাকে পানি, আর পাঁচ মাস সবুজের দিগন্তজোড়া মাঠ। কখনো পানির ঢেউ, কখনো বোরো ধান বাতাসে দোল খায়। পানিতে থাকা মাছ আর মাঠে থাকা ধান এই দুই সম্পদকে কেন্দ্র করে চলে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন। মে মাসের শেষ দিকে হাওর পানিতে ভরপুর থাকে। কিন্তু এবার নেত্রকোনার হাওরগুলো এখন অনেকটাই পানিশূন্য।

পানি না থাকায় বিস্তীর্ণ একেকটা হাওর যেন খাঁ খাঁ করছে। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির অপেক্ষায় দিন গুনছেন হাওরপারের মানুষেরা। জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি ও কলমাকান্দা উপজেলার আংশিক এলাকা মূলত হাওরাঞ্চল। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ শুকনা মৌসুমে বোরো ফসল চাষ করেন ও বর্ষায় মাছ ধরে জীবিকা চালান।

গত রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মদনের উচিতপুর, গোবিন্দশ্রী, খালিয়াজুরির কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, ছায়ার হাওর, তলার হাওরসহ বেশ কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা গেছে সব কটিই পানিশূন্য। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে। এতে হাওরের নিচু এলাকায় সামান্য পানি জমেছে।

খালিয়াজুরির পুরানহাটি এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকেই বৃষ্টি ও উজানের পানি এসে হাওর ভরে যায়। কিন্তু গত এক বছর থেকে হাওরে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত বছরও জুনের মাঝামাঝি সময়ে হাওরে পানি এসেছিল। এ বছরও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। এর আগে কোনো বছর এ সময়ে পানিশূন্য হাওর আমরা দেখিনি।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনায় ৬৮টি হাওর আছে। এ ছাড়া নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা ১৮৮। সব মিলিয়ে জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৫৬ হাজার ৬৭৬ হেক্টর। বছরে এসব জলাশয় থেকে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। ৪৮ হাজার ৩৮৪ জন নিবন্ধিত মৎস্যজীবী মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনিবন্ধিত মৌসুমি জেলে রয়েছেন আরও প্রায় ১২ হাজার। তাঁরা মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে সংসার চালান।

নেত্রকোনায় ৬৮টি হাওর আছে। এ ছাড়া নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা ১৮৮। সব মিলিয়ে জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরের আয়তন ৫৬ হাজার ৬৭৬ হেক্টর।

কেন পানি নেই, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টি হলে এর প্রভাব পড়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরগুলোতে। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ থেকে ১ জুন পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে ৪ হাজার ৪২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আর নেত্রকোনার দুর্গাপুরে বৃষ্টি হয় ১ হাজার ৫৮ দশমিক ৬ মিলিমিটার। গত বছর ওই সময়ে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয় ৬৭৫ দশমিক ৭ মিলিমিটার। আর দুর্গাপুরে বৃষ্টি হয় ৩৪৪ দশমিক ২৬ মিলিমিটার। এ বছর চেরাপুঞ্জিতে গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে হাওরে পানি চলে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হাওর পানিশূন্য বলে মনে করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্ষায় হাওরে পানি নেই, এটা আমাদের জন্য কোনো সুখবর নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। হাওরাঞ্চলে মাছের ওপর অনেক মানুষ নির্ভর করে। পানি না থাকায় প্রজনন হচ্ছে না। ফলে মিঠাপানির এসব মাছ, শামুকসহ জলজ প্রাণী অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’

কিছু কিছু হাওরে একেবারেই পানি নেই। বিস্তীর্ণ এলাকা যেন খাঁ খাঁ করছে
ছবি: প্রথম আলো

হাওরে পানি না থাকায় যেসব সমস্যা
মাছের প্রজননকাল ও ডিম ছাড়ার সময় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। হাওরে পানি না থাকায় মা মাছ ডিম ফুটিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। আর পানি তলানিতে যাওয়ায় অসংখ্য মা মাছ মারা পড়ছে। মাছের পাশাপাশি ঝিনুক, শামুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও পানিজাতীয় উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষদের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া হাওরে নৌকা চালিয়ে আয় করা লোকদের বেকার সময় কাটাতে হচ্ছে। পর্যটকশূন্য থাকায় নৌঘাটের স্বল্প আয়ের মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও একই অবস্থায় আছেন। নৌকা বানানোর কারিগরেরাও অনেকটা বেকার। আবার যাঁরা হাওরের পানিকে ঘিরে হাঁসের খামার করেন, তাঁরাও আছেন বিপাকে।

খালিয়াজুরির বল্লভপুর গ্রামের হেলাল মিয়া বলেন, ‘হাওরে পানি না থাহনে আমরার কষ্ট হইতাছে। এই সময় গ্রামের অনেকেই হাওরে মাছ ধইরা সংসার চালাই। এই এলাকাত সহজে কাম-কাজেরও সুযোগ পাওয়া যায় না। আমার মতো মানুষের দুইবেলা ভাত খাওয়া কঠিন হইয়া যাইতাছে। আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চাতাছি, হাওরে পানি হোক।’

উপজেলার চাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘হাওর এলাকাত দিন দিন আকাল নাইম্মা আইতাছে। গত বছরও হাওরে পানি দেরি কইরা আইছিল। এইবারও একই অবস্থা। আমার ৬২ বছর বয়সে এই সময়ের মধ্যে এমন পানিশূন্য হাওর আর আগে দেখছি না। এলাকায় মাছের আকাল দেখা দিচ্ছে। জেলেরা কষ্টে আছে। হাওরে পানিতে সহস্রাধিক নৌকা, ট্রলার আসা-যাওয়া করত। এবার পানি না থাকায় সব বন্ধ।’

যে জলাশয় আছে, তা যেন শুকিয়ে না ফেলা হয়, মা ও পোনা মাছ যেন না ধরা হয় সে ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ, প্রশাসনসহ জনসাধারণের নজর রাখতে হবে।
মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

করণীয় কী
হাওরে পানি না থাকলেও আশার কথা শুনিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, হাওরে নানা রকমের মাছ থাকে। পানি এলে এসব মাছের দুই থেকে তিনবার ডিমপাড়ার সম্ভাবনা আছে। আর পানিতে থাকা প্লাঙ্কটন ছাড়াও জলজ গাছ এবং আগাছার গায়ে মাছের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ খাবার পেরিফাইটনের উৎপাদন মাছের শারীরিক বৃদ্ধিতে সহায়ক। যে জলাশয় আছে, তা যেন শুকিয়ে না ফেলা হয়, মা ও পোনা মাছ যেন না ধরা হয় সে ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ, প্রশাসনসহ জনসাধারণের নজর রাখতে হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর জানান, জেলায় বছরে উৎপাদিত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন মাছের মধ্যে অর্ধেকের বেশি হয় হাওরে। হাওরে পানি এলেই প্রচুর পোনা অবমুক্ত করা হবে। মৎস্য আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।