টিলার মালিকই জানেন না, কারা মাটি কাটছেন

লালমাই পাহাড়ের টিলা কাটা বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চক্রটি একের পর এক টিলা কাটছে। 

কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে টিলা কেটে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত বুধবার সদর দক্ষিণ উপজেলার সালমানপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের টিলা ও সবুজে ঘেরা লালমাটির মনোলোভা দৃশ্য পর্যটকদের কাছে দারুণ উপভোগ্য। সেই পাহাড়ের টিলায় রাতের আঁধারে মাটি কাটছে একশ্রেণির সংঘবদ্ধ অসাধু চক্র। এবার চক্রটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কের গা ঘেঁষে একটি টিলা কেটে মাটি বিক্রি করছে। টিলার মালিকেরা জানেন না, কারা টিলা কাটছেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ তাঁরা। 

এদিকে লালমাই পাহাড়ের টিলা কাটা বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চক্রটি একের পর এক টিলা কাটছে। 

সরেজমিন গত সোমবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, লালমাই পাহাড়ের জঙ্গল লালমাই মৌজার সালমানপুর এলাকার ৩০ শতাংশ জায়গা নিয়ে থাকা একটি টিলা কাটা। টিলার অনেকটা অংশে মাটি নেই। সেখানে ট্রাক্টরের চাকার ছাপ আছে। স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হাশেম প্রতিদিন পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। সোমবার তিনি পাতা সংগ্রহ করতে আসেন। তিনি বলেন, দু–তিন দিন পর এখান থেকে রাতে মাটি কাটা হয়। এরপর মাটি ট্রাক্টরে করে নেওয়া হয়। 

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আট বছর আগে লাকসামের ইছাপুরা গ্রামের নাসির উদ্দিন ও সাইফুদ্দিন এই দুই ভাই এবং কুমিল্লা নগরের নোয়াগাঁও এলাকার মো. ইউনুস মিয়া ওই টিলা কেনেন। কিছুদিন আগে খবর পান তাঁদের টিলা থেকে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। 

এ প্রসঙ্গে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ জানতে পারি, আমাদের টিলা কাটা হচ্ছে। কিন্তু কে বা কারা কাটছে তা জানতে পারি না। তাই আইনি পদক্ষেপও নিতে পারছি না। পরে বিষয়টি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেনকে জানাই।’ 

বিজয়পুর ইউপির চেয়ারম্যান পারভেজ হোসেন বলেন, ‘টিলা কাটা হচ্ছে বলে মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি।’ কুমিল্লার ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর বলেন, লালমাই পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার প্রস্থ ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এটি একটি বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি। এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। এই পাহাড়ের আয়তন ৩৩ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটার। সদর দক্ষিণ উপজেলায় এই পাহাড়ের অবস্থান। আনুমানিক ২৫ লাখ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে এই পাহাড় গঠিত হয়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে অসাধু ভূমিদস্যুরা এই পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি করছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে বাপা প্রশাসনের কাছে বহুবার লিখিত অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে মাটি খেকোচক্র এই কাজ করছে। কিন্তু কোন ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। 

২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি লালমাই পাহাড় রক্ষায় জনস্বার্থে একটি রিট করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লালমাই পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। তখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস, সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক অবাধে টিলা কেটে সমতল করে। এর আগে ঢাকা-চট্রগ্রাম চার লেন মহাসড়ক ও কুমিল্লা-নোয়াখালী চার লেন মহাসড়ক করতে লালমাই পাহাড় কেটে মাটি নেওয়া হয়। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ক্যাম্পাসের জন্য প্রায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে ১৩১ একর জমি পাহাড় ও টিলাশ্রেণির। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার জন্য টিলা কেটে সমতল করা হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান বলেন, লালমাই পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। কোনো ভাবেই টিলা কেটে সাবাড় করা যাবে না। সেখানে অভিযান চালানো হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের জানানো হোক। 

পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন বলেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পেরেছি। কোনোভাবেই পাহাড়, টিলা কাটা যাবে না।’