কাকডাকা ভোরে শুরু হয় ‘শ্রমিকের হাট’
‘আমি হাটে মানুষ ঘাটে মানুষ মাঠে মানুষ দেখতে পাই’—গানটির ভেতর ঘাট, মাঠ থাকলেও এখানে শুধু হাটটিই আছে। একটা ‘শ্রমিকের হাট’। শীত, ঝড়–বাদল যা–ই থাক—কয়েক শ মানুষের এই হাট বসে সেই কাকডাকা ভোরে। রোদ বাড়ে, হাটের শ্রমিকেরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েন। একসময় যানবাহনের চলাচল আর দোকানপাট খোলা শুরু হলে শ্রমিকের হাট মিলিয়ে যায়।
মৌলভীবাজার শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত স্থান হলো চৌমোহনা চত্বর। প্রতিদিন ভোরে স্থানটি শ্রমিকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। কাজের সন্ধানে স্থানীয়সহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকেরা এই হাটে জড়ো হন। তাঁদের কেউ বারো মাসই কাজের খোঁজে এখানে আসেন, কেউ আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। আবার কেউ কেউ ধান কাটাসহ বিভিন্ন মৌসুমে বাড়তি আয়ের খোঁজে ‘খ্যাপ’ দিতে আসেন এখানে।
মাসখানেক হলো হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ থেকে এসেছেন মো. জুয়েল মিয়া। এখন চলে অগ্রহায়ণ মাস, আমন ধান কাটার মৌসুম। অন্যদের সঙ্গে ধান কাটার কাজে এসেছেন জুয়েল। এ সময় বাড়তি শ্রমিকের চাহিদা থাকে। তিনি জানালেন, বাড়ির কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে আসেন। কিছুদিন সবার সঙ্গে থেকে কাজ করেন। এরপর চলে যান। এবার এখানে আসার পর এক মাসের মধ্যে হয়তো চার-পাঁচ দিন কাজ পাননি, বাকি সব দিনই কাজ করেছেন।
জুয়েল মিয়া বলেন, ‘কাজের কোনো রকম নাই। যখন যেটা পাই, তা–ই করি। কখনো ধান কাটি, কখনো মাটি কাটি, কখনো গাড়িতে বই (গাড়িশ্রমিকের কাজ)। এখন ধানই কাটছি।’ তিনি জানিয়েছেন, এক কিয়ার (৩০ শতক সমান ১ কিয়ার) জমির ধান কেটে দিলে তাঁরা ২ হাজার ৮০০ টাকা পান। খেতের মালিক নিজ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যান, কাজের মধ্যে চা-নাশতা খাওয়ান। এখন একজন শ্রমিকের রোজ হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। তবে কাজের ধরন ও চাহিদা অনুযায়ী রোজের মজুরি ওঠানামা করে।
মজুরির প্রসঙ্গ উঠতেই মো. হৃদয় মিয়া বলেন, ‘৮০০ টাকা রোজ অইয়া কিতা অইতো (কী আর হবে)। চাউলের কেজি ৮৫ টাকা। সারা দিন কাম করি, একটু ভালা চাউল তো খাওয়া লাগে। এ ছাড়া তেলের দাম, পেঁয়াজর দামসহ হকল (সকল) জিনিসর দাম বাড়তি। এতা (এই) রুজিয়ে কুলায় (পোষায়) না।’
বুধবার সকাল ছয়টার দিকে শহরের চৌমোহনা চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, কুয়াশার চাদরে ঢাকা শহরের সড়ক, অলিগলি, বাসাবাড়ি। তখন স্থানটি অনেকটা ফাঁকা থাকলেও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। বিভিন্ন দিক থেকে কাঁধে টুকরি-কোদাল, হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে চত্বরের দিকে শ্রমিকেরা আসছিলেন।
শ্রমিকেরা বললেন, এই হাট ১৫-২০ বছর ধরে বসে। শুরুতে দু-চারজন শ্রমিক এসে বসতেন। ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা এখন ৩০০ থেকে ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। সকাল ছয়টার দিক থেকে শ্রমিকদের আসা শুরু হয়, ৯টা-১০টা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন, এরপর কাজ না পেলে ফিরে যান। এখানে মৌলভীবাজার জেলার স্থানীয় লোকজনসহ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, বাহুবল, আজমিরীগঞ্জ এলাকার লোকজনই বেশি।
তরুণ মো. শরিফ উল্লাহ কাজের খোঁজে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলেন। তিনি জানালেন, তাঁদের মূল বাড়ি আজমিরীগঞ্জ হলেও মৌলভীবাজারেই তাঁর জন্ম। সকাল হলেই এখানে কাজের জন্য আসেন। সপ্তাহে এক-দুই দিন আছে কাজ পাওয়া যায় না, বাকি সব দিনই এখন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন।
দেখতে দেখতে বেলা অনেকটা বেড়ে যায়। কুয়াশা কেটে হেমন্তের ঝলমলে রোদ শহরের দালানকোঠা ডিঙিয়ে সড়কেও এসে পড়ে। অনেক শ্রমিকই এর মধ্যে কাজ পেয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেছেন।