বায়ুদূষণ
গাজীপুর এখন ধুলার জনপদ
গাজীপুর শহর ও আশপাশের এলাকার কোথাও ধুলাবালু থেকে রেহাই মেলে না। এতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। বাড়ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগী।
গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী তুরাগ সেতু থেকে শুরু করে চেরাগআলী পর্যন্ত ধুলাবালু আর ময়লা–আবর্জনায় সয়লাব হয়ে আছে। একই অবস্থা ভোগড়া বাইপাস থেকে কালীগঞ্জ উপজেলার উলুখোলা পর্যন্ত। শিল্প–অধ্যুষিত গাজীপুর এখন যেন শিল্পকারখানার ধোঁয়া আর ধুলার জনপদ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও শিল্পায়নের কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বিআরটিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের কারণে গত কয়েক বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে কয়েক গুণ।
গাজীপুর শহর ও আশপাশের এলাকার কোথাও ধুলাবালু থেকে রেহাই মেলে না। এতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। জেলার টঙ্গী ও ধীরাশ্রম এলাকায় হাই ভলিউম এয়ার স্যাম্পলার মেশিন বসিয়ে প্রতিদিন বাতাসে ধূলিকণা পর্যবেক্ষণ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, গত বুধবার গাজীপুরের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ১৮৬ মাইক্রোগ্রাম। বায়ুতে এই পরিমাণ ধুলা অস্বাস্থ্যকর। কয়েক দিন আগে পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ ছিল। ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ২১২ মাইক্রোগ্রাম, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। ধুলাবালুতে একাকার অবস্থা।
এবারের শীত মৌসুমে গাজীপুরে বাতাসে ভারী ধূলিকণার পরিমাণ বাড়তে থাকায় দূষিত বায়ুর জেলা হিসেবে তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে গাজীপুর। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান। এ সময় নির্মাণসামগ্রী খোলা অবস্থায় মজুত, পরিবহন ও পানি না ছিটিয়ে বায়ুদূষণ করার দায়ে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি মহাসড়ক নির্মাণকারী দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার করে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
জেলার তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার রোগী আসেন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শ্বাসকষ্টজনিত রোগী। বায়ুদূষণে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ ফুসফুসসংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক মাস ধরে হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত রোগীদের ভিড় বেড়েছে।
শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা রাজীব হোসেন। তিনি বলেন, বাইরের ধুলাবালু থেকে তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। এখন প্রতিদিন অক্সিজেন নিতে হয়।
হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত রোগী আসছেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। এর মূল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ।
এই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত রোগী আসছেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। এর মূল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ। এ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, যেমনটা আমরা করোনাকালে ব্যবহার করেছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গাজীপুর নগরের টঙ্গীর স্টেশন রোড, কলেজ গেট, মিল গেট, টঙ্গী বাজারসহ বেশ কিছু এলাকার বায়ুর প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ধূলিকণা ও দূষিত পদার্থের পরিমাণ ২০০ থেকে সাড়ে ২২৪ মাইক্রোগ্রামে ওঠানামা করছে। যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা ১৬৫ মাইক্রোগ্রাম। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গীর সরকারি হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতাল এলাকাও রয়েছে ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে। পাশাপাশি গাজীপুর শহর ও আশপাশের এলাকায় স্টিল মিলসহ নানা ধরনের কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়ায়ও বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাতাস। প্রতিদিনই সকাল থেকে ধুলার আবরণে ঢাকা পড়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুর শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা হওয়ায় এবং এখানে মেগা প্রজেক্ট চলতে থাকায় বর্তমানে দূষণ একটু বেশি হচ্ছে। নির্মাণসংক্রান্ত নীতিমালা মেনে না চলায় বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। সীমিত জনবল নিয়েই দূষণ রোধে জরিমানাসহ নানা ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দূষণের দায়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হচ্ছে দাবি নয়ন মিয়ার।
নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধুলাবালুর কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তাঁরা। এরপরও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। ধুলাবালুর কারণে চরম ভোগান্তির মধ্য দিয়েই স্কুল-কলেজে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
শহরের নগরীর মোগরখাল এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। ধুলাবালুতে একাকার অবস্থা। ঢাকা-বাইপাস সড়কের কাজের কারণে ধুলা আরও বেশি উড়ছে। ধুলাবালু বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) গাজীপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বলেন, গাজীপুরের শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এ থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।