বিজয়ের খবরে পতাকা হাতে অনেকে রাস্তায় চলে আসেন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই মুক্ত হয়েছিল কিছু অঞ্চল। কেমন ছিল সেসব অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষের আবেগ-অনুভূতি। সেই সময়ের চিত্র।

একাত্তরের শহীদদের স্মরণে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার শহীদনগরে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‌‘বীর বাঙালি’ছবি : প্রথম আলো

পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর পাবনার সাঁথিয়া ছাড়ে। বিজয়ের খবরে অনেকে পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসেন। কেউ আনন্দে কাঁদতে থাকেন, কেউ হাসেন। আবার কেউ নিখোঁজ স্বজনদের নাম ধরে আহাজারি করতে থাকেন। এমন আনন্দ–বেদনার খণ্ড খণ্ড চিত্র মিলে তৈরি হয়েছিল সাঁথিয়ার বিজয়ের দিনের গল্প।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর সাত) বইয়ে বলা হয়েছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সময় যত এগোতে থাকে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধও বাড়তে থাকে। উল্লেখযোগ্য একটি যুদ্ধ হলো ১৯ এপ্রিলের ডাববাগান যুদ্ধ। 

সেই যুদ্ধের বিষয়ে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী প্রকাশিত আবুল কালাম আজাদের মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা: পাবনা জেলা বইয়ে বলা হয়েছে, বগুড়া থেকে পাবনার নগরবাড়ী সড়কের পাশে ডাববাগানের অবস্থান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। ১৯ এপ্রিল দুপুরবেলা পাকিস্তানি বাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ডাববাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা করে। একটি দল সড়ক ধরে, আরেকটি দল পেছন দিক থেকে ডাববাগান গ্রামে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, সে অবস্থাতেই অস্ত্র তুলে নেন। দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫ জন নিহত হয়। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঁথিয়া উপজেলার কমান্ডার ছিলেন মো. নিজাম উদ্দিন। তিনি তাঁর একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ে লিখেছেন, সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প ও গ্রামটি লক্ষ্য করে মর্টার শেল ছোড়ে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ঘরবাড়িতে। 

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (১০ম খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, ডাববাগানের পাশাপাশি রামভদ্রবাটি, করিয়াল, বড়গ্রাম ও সাটিয়াকোলা গ্রাম একে একে পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে ধরে এনে আমগাছের নিচে সারি করে দাঁড় করিয়ে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা করে।  

যুদ্ধ শেষে ডাববাগানের নাম বদলে যায়। এখানে শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নতুন নাম হয় ‘শহীদনগর’। আর ১৯ এপ্রিল দিনটিকে ঘোষণা করা হয় ‘শহীদনগর দিবস’ হিসেবে। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীর বাঙালি’ নামের একটি স্মৃতিসৌধ। 

১৪ মে রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাউশগাড়ি ও রূপসীতে গণহত্যা চালায় বলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (১০ম খণ্ড) বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঘুমন্ত মানুষ হঠাৎ গুলির শব্দ জেগে দিগ্‌বিদিক ছুটতে থাকে। বাউশগাড়ি ও রূপসী গ্রামের পাঁচ শতাধিক নারী–পুরুষ প্রাণভয়ে বাউশগাড়ি গ্রামের বিশাল বাঁশঝাড়ের এক গভীর গর্তে লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাশফায়ার করে। চারজন ছাড়া সেখানকার সবই শহীদ হন। তাঁদের বাউশগাড়ি-রূপসী গণকবরে সমাহিত করা হয়। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। 

একই বইয়ে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি সেনারা যখন সাঁথিয়ায় তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত, তখন বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন চূড়ান্ত আঘাতের। ৭ ডিসেম্বর থানা এলাকায় দুই পক্ষের সম্মুখযুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।

পরের দিন ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আবারও সাঁথিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটে। পরে ৯ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়ায় প্রবেশ করেন। বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে তরুণেরা ছুটে আসে থানা চত্বরে। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সাঁথিয়ায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। 

সেই দিনের কথা স্মরণ করে সাঁথিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আফতাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের স্রোত চলতে থাকে থানার দিকে। অনেককেই সেদিন আনন্দে কাঁদতে দেখেছি। মনে হচ্ছিল, আমরা এক নতুন পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি।’