মানিকগঞ্জের তিনটি আসন ফিরে পেতে তৎপর বিএনপি
২০০৮ সালে আসন একটি কমে হয় তিনটি। এর পর থেকে তিনটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন।
একসময় বিএনপির ‘দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত মানিকগঞ্জের সব কটি আসন ২০০৮ সালে দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির অনুপস্থিতিতে পুরোনো দুর্গ ফেরত পেতে চায় বিএনপি। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সেখানে ভাগ বসাতে চায় জামায়াতে ইসলামী।
দল গঠনের পর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জের চারটি আসনের সব কটিতেই বিএনপির প্রার্থীরা জয় পান। পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সব কটি আসন ধরে রেখেছিল দলটি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি কমিয়ে তিনটি আসন পুনর্বিন্যাস করে নির্বাচন কমিশন। এরপর নবম থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবকটি আসনে জেতে আওয়ামী লীগ। এবার আওয়ামী লীগ না থাকায় ভিন্ন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে সব আসনে জয় পেতে চেষ্টায় আছেন বিএনপির প্রার্থীরা।
কয়েক মাস আগে সব আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রচার শুরু করে জামায়াত। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের খেলাফত মজলিসসহ ইসলামি কয়েকটি দলের প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি (জাপা), গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি।
মানিকগঞ্জ-১ (ঘিওর, দৌলতপুর ও শিবালয়)
বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের এই আসনে প্রথম ধাপে কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। দ্বিতীয় ধাপে ৪ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলার আহ্বায়ক কমিটির ১ নম্বর সদস্য এস এ জিন্নাহ কবিরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি ছাড়া দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বড় ছেলে জেলা বিএনপির সদস্য খোন্দকার আকবর হোসেন, দৌলতপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক তোজাম্মেল হক এবং জাসাসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. আমিনূল হক।
খোন্দকার আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো দলের সিদ্ধান্ত নয়, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত। এটা প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষেই কাজ করব।’
এস এ জিন্নাহ কবির বলেন, মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় দলের আরও প্রতিযোগী ছিলেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁরা সাময়িক মনঃক্ষুণ্ন হতে পারেন। তবে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে তাঁরাও ধানের শীষের জন্য ভোটের মাঠে কাজ করবেন।
এই আসনে ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এডিএফ) ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য আবু বকর সিদ্দিককে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। তিনি বলেন, ‘এখানে দাঁড়িপাল্লার জনপ্রিয়তা অনেক। আমি নির্বাচনী এলাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছি, মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ ভালো আছে।’
এ ছাড়া এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলার আহ্বায়ক ওমর ফারুক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী হিসেবে ঘিওর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ প্রচার শুরু করেছেন। গত ১৯ নভেম্বর নির্বাচনী এলাকায় লিফলেট বিতরণ ও ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন ওমর ফারুক।
মানিকগঞ্জ-২ (হরিরামপুর, সিঙ্গাইর ও সদরের ২ ইউনিয়ন)
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি মঈনুল ইসলাম খানকে মনোনয়ন দিয়েছে দল। তাঁর বাবা শামসুল ইসলাম খান এখানে চারবার এমপি এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক করে আসছেন তিনি। মঈনুল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকার যেখানে যাচ্ছি, ভোটারদের বেশ ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। নির্বাচন উৎসবমুখর হবে, ভালো ফলাফল আশা করছি। আমি নির্বাচিত হলে নদীভাঙনরোধসহ ভাঙনকবলিত এলাকার অসহায় মানুষের জন্য কাজ করার সদিচ্ছা রয়েছে।’
প্রায় ছয় মাস আগে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. জাহিদুর রহমানকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। এখানে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ সালাউদ্দিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিঙ্গাইর উপজেলার সভাপতি দ্বীন মুহাম্মাদ, সিপিবির জেলা সভাপতি অধ্যাপক আবুল ইসলাম শিকদার নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন।
২০০৮ সালে এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির (জাপা) সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জেলা সভাপতি এস এম আবদুল মান্নান এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার তাঁকে এখনো প্রচার-প্রচারণায় দেখা যায়নি। আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমি নির্বাচন করব। তবে কীভাবে ও কোথায় করব, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি দল থেকে নির্বাচন করার সুযোগ পাই, তাহলে দল থেকেই করব। অন্য চিন্তাও করতে পারি, যা এখনো ঠিক করা হয়নি।’
মানিকগঞ্জ-৩ (সদর ও সাটুরিয়া)
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলার আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও শিল্পপতি প্রয়াত হারুনার রশিদ খান মুন্নুর বড় মেয়ে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজপথে থেকে জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিএনপির কয়েকজন নেতার মতে, একই সঙ্গে ধানের শীষে ভোট দিতে ভোটারদের আস্থা অর্জনে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সভা–সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ করে আসছেন। পাশাপাশি নির্বাচনী বিভিন্ন এলাকায় বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
আফরোজা খানম বলেন, মানিকগঞ্জ বিএনপির দুর্গ, বিএনপির ঘাঁটি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অসংখ্যবার এই জনপদে এসেছেন। এ জেলার প্রতিটি আসনেই বিএনপি বারবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে, এবারও হবে। ভোটাধিকার ছিনতাই, হামলা-মামলা কিছুই সাধারণ মানুষ থেকে বিএনপিকে দূরে রাখতে পারেনি। প্রচার-প্রচারণায় যেখানেই যাচ্ছেন, ধানের শীষের প্রতি সাধারণ ভোটার ও মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার নিদর্শন দেখতে পাচ্ছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সভা–সমাবেশ ও উঠান বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন নির্বাচনী এলাকার সাধারণ ভোটাররা।
বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী পরিচালক দেলওয়ার হোসাইনকে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াত। সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন তিনি। দেলওয়ার হোসাইন বলেন, ভোটাররা পরিবর্তন চান। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মানুষ দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেবেন।
এখানে এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলার সদস্যসচিব নাহিদ মনির, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুফতি শাহ্ সাঈদ নূর, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) জেলার প্রধান সমন্বয়ক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রচার চালাচ্ছেন। তবে এ আসনে জাতীয় পার্টি, সিপিবিসহ অন্যান্য দলের নেতাদের প্রচার-প্রচারণায় এখনো দেখা যায়নি।