মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রয় দেন তিনি

প্রতিদিন মানসিক প্রতিবন্ধী ভবঘুরে ব্যক্তিদের খাওয়ান মতি মিয়া। অনেকের চুল কেটে বা গোসল করিয়ে দেন। রাতে নিজের দোকানে থাকতেও দেন।

মতি মিয়া

তখন সন্ধ্যা। রাজশাহীর বাগমারা থানার মোড়ের একটি চায়ের দোকানের এক কোণে থালাভর্তি খাবার ও পানি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মতি মিয়া। কিছুক্ষণ পর মানসিক প্রতিবন্ধী ভবঘুরে এক তরুণ গান গাইতে গাইতে ছুটে আসেন সেখানে। উভয়ের মুখেই মৃদু হাসি। এসেই মাটিতে বসে পড়েন তরুণ। সামনে খাবারের থালা, পানির জগ ও গ্লাস রেখে পাশে বসেন মতি মিয়া। যত্ন করে খাওয়ান তাঁকে।

এভাবে প্রতিদিন মানসিক প্রতিবন্ধী ভবঘুরে ব্যক্তিদের খাওয়ান মতি মিয়া (৬৪)। অনেকের চুল কেটে বা গোসল করিয়ে দেন। রাতে থাকার জায়গাও দেন। অসুস্থ অনেককে চিকিৎসাও করান। নিজেই আর্থিকভাবে অসচ্ছল মতি মিয়া। এরপর এভাবে প্রায় দেড় যুগ ধরে নীরবে সহায়-সম্বলহীন মানুষের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে।

নাম মতিউর রহমান হলেও সবার কাছে তিনি মতি মিয়া নামে পরিচিত। বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ-রাজশাহী সড়কের পাশে থানার মোড়ে তাঁর দোকান আছে। মূলত চায়ের দোকান হলেও সকালে খিচুড়ি ও দুপুরে মাঝেমধ্যে ভাত-তরকারি বিক্রি করেন তিনি। দোকানে রান্না না হলে বাসা থেকে খাবার এনে আশ্রিত ব্যক্তিকে খাওয়ান।

মতি মিয়ার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাদারপুগ্রামে। ১৯৮৮ সালে বিয়ে করে বাগমারায় আসেন। দোকানের পাশে সরকারি জমিতে কুঁড়েঘর নির্মাণ করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকছেন তিনি। দোকান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে সংসার।

দেড় যুগে অসংখ্য মানসিক প্রতিবন্ধী ভবঘুরের পাশে দাঁড়িয়েছেন মতি মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে দুই থেকে তিনজন ভবঘুরে বা মানসিক প্রতিবন্ধী আসেন তাঁর কাছে। নারী, পুরুষ, কিশোর, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের এসব আশ্রয়হীন মানুষকে আশ্রয় দেন তিনি। সর্বোচ্চ সাত থেকে আট দিন থাকেন একেকজন। তাঁদের প্রতি মায়াও জন্মে যায়। তবে একটা পর্যায়ে তাঁরা চলে যান। অনেককে রাতে দোকানে রেখে বাড়িতে ঘুমাতে যান। সকালে এসে আর পান না। প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এখন সয়ে গেছে জানিয়ে মতি মিয়া বলেন, একজন গেলে আরেকজন আসেন। এই তো জগতের নিয়ম।

থানার মোড়ের অন্য দোকানিরা মতি মিয়াকে নিয়ে গর্ব করেন। তাঁরা বলেন, অনেক প্রতিবন্ধী এসে অস্বাভাবিক আচরণ করেন। নাম-পরিচয়সহ যা-ই জানতে চাওয়া হোক, কথা বলেন না। মতি মিয়া তাঁদের সবাইকেই আপন করে নেন। তাঁর ডাকে ঠিকই সাড়া দেন এসব মানুষ। অনেকে কথাও বলেন তাঁর সঙ্গে। তবে অসংলগ্ন ও অগোছালো এসব আলাপ থেকে নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয় না।

স্থানীয় ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিনিধির। তাঁদের অনেকেই একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, ২০১৮ সালে এক ভবঘুরে নারী (বয়স আনুমানিক ৪০) থানার মোড়ে আশ্রয় নেন। সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মাথা ফেটে যায়। কয়েক দিন পর তাঁর মাথায় বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ওই নারীকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মতি মিয়া। তবে দুই দিনের মধ্যে তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পালিয়ে আবার মতি মিয়ার কাছে চলে আসেন। এরপর ওই নারীর থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেন তিনি। টানা ১৫ থেকে ২০ দিনের সেবাযত্নে সুস্থ করে তোলেন তাঁকে। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ওই নারী না বলেই চলে যান। ২০১৪ সালে ভবঘুরে এক ব্যক্তি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে তাঁকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দাফনের ব্যবস্থা করেন মতি মিয়া। এ রকম অনেক নজির আছে।

মতি মিয়া বলেন, মানসিক প্রতিবন্ধী ও ঠিকানাবিহীন ভবঘুরেদের দেখলে মায়া জন্মে তাঁর। প্রথমে পরিবারের সদস্যরা আপত্তি জানালেও এখন তাঁরাও সহযোগিতা করেন। মতি মিয়ার স্ত্রী জোবেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিজেরাই অভাবে থাকেন। এরপরও প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ দিন এমন ভবঘুরেদের খাবার দিতে হয়। এখন অসহায় এসব মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরে ভালো লাগে।

স্থানীয় বাসিন্দা ভবানীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পথহারা মানসিক প্রতিবন্ধী ভবঘুরেরা বাগমারা থানার মোড়ে আসতে পারলেই হলো তাঁদের থাকা-খাওয়া ও সেবাযত্নের দায়িত্ব নেন মতি মিয়া। নিজে অভাবী মানুষ হয়েও মানবতার দৃষ্টান্ত গড়েছেন তিনি।