ঈদে গরু বিক্রি না হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার খামারিরা লোকসানে

ঢাকায় কোরবানির পশুর হাটে গরুর কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ খামারিরা। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কান্তপুর গ্রামে নিজ খামারে গরুর পাশে খামারি হাজ্জাজ আলী
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবছর ঈদুল আজহা সামনে রেখে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে বিপুলসংখ্যক গরু ঢাকার কোরবানির পশুর হাটে পাঠানো হয়। এখানকার খামারি ও ব্যাপারীরা বেশির ভাগ সময় লাভের মুখ দেখলেও এ বছর ব্যতিক্রম। কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় অনেকেই ঢাকায় নেওয়া গরু ফিরিয়ে এনেছেন। আবার কেউ কেউ বাধ্য হয়েই কম দামে বিক্রি করেছেন।

ঢাকা থেকে ফিরিয়ে আনা গরু আশানুরূপ দামে বিক্রি নিয়ে মালিকেরা পড়েছেন নতুন ভাবনায়। ব্যাপারীরা যেসব গরু ঢাকায় নিয়েছেন, তার বেশির ভাগেরই মালিক প্রান্তিক কৃষক। আয়ের অন্যতম প্রধান খাতের এই বিপর্যয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলাজুড়ে গরু পালনকারী ও খামারিরা আহাজারি করছেন।

আলমডাঙ্গা উপজেলায় বাড়ি বাড়ি গরু পালনের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। পাশাপাশি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে উঠছে একের পর এক বাণিজ্যিক খামার। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা উদ্যোক্তা হিসেবে ঝুঁকছেন এই খাতে। সফলও হচ্ছেন তাঁরা। ক্রমশ বড় হচ্ছে প্রাণিসম্পদের এই খাত।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) আবদুল্লাহিল কাফি জানান, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এ বছর উপজেলায় মোট ৩০ হাজার গরু প্রস্তুত করা হয়। যার মধ্যে প্রায় ১২ হাজার গরু সরাসরি খামার ও স্থানীয় হাটগুলোতে বিক্রি হলেও বাকি ১৮ হাজার নেওয়া হয় ঢাকার কোরবানির পশুহাটগুলোতে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় ঢাকায় নেওয়া গরুর অন্তত ৩০ শতাংশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ইউএলও বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে খামারিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ফিরিয়ে আনা গরুর চেকআপ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ খাতে লাভবান হতে শুধু কোরবানিকেন্দ্রিক গরু না পালন করে বছরব্যাপী কেনাবেচা করা যায়, তেমন গরু পালনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৭ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাসের পর হীরা খাতুন চাকরির পেছনে না ছুটে ২০১৮ সালে প্রায় ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগে আলমডাঙ্গার কালিদাসপুর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামে গরুর খামার গড়ে তোলেন। এই নারী উদ্যোক্তা গরুর খামার করতে গিয়ে পাঁচ বছরে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে এ বছর ঢাকায় কোরবানির পশুহাটে বিক্রির জন্য গরু পাঠিয়ে অভিজ্ঞতা সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। হীরার বাবা আবদুর রহমান ও ৩ জন রাখাল গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকার গাবতলী পশুহাটে এ বছর ১৭টি গরু নিয়ে যান।

হীরা বলেন, খামারে এসে ব্যাপারীরা যে ১৭টি গরুর দাম একত্রে ২৩ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন, ঢাকায় সেই গরুগুলোর দাম তার অর্ধেক বলেনি কেউ। সাতটি গরু ২ লাখ টাকা লোকসানে বিক্রির পর বাকি ১২টি গরু ফিরিয়ে আনা হয়েছে। খরচ হয়েছে আরও ১ লাখ। সব মিলিয়ে এ বছর লোকসান তিন লাখ টাকা।

ডাউকি ইউনিয়নের বাদেমাজু গ্রামের খামারি জয়নাল আবেদিনের অভিজ্ঞতা আরও করুণ। কলেজপড়ুয়া ছেলে সবুজ হোসেন, ভাগনে আসাবুল হক ও ৫ জন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে মোট ২৪টি গরু বিক্রি ও লাভের আশায় ঢাকার গাবতলী পশুহাটে যান। ৮টি গরু কেনাদামে বিক্রির পর বাকি ১৬টি গরু নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন এই খামারি।

জয়নাল বলেন, এসব গরু ঢাকায় নিয়ে যাওয়া-আসা, খাওয়া, শ্রমিকসহ অন্যান্য বাবদ প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। খরচের এই দুই লাখ টাকা পকেট থেকে গুনতে হয় তাঁকে। শুধু তাই নয়, ঢাকার কোরবানির পশুর হাটে বৃষ্টি-কাদার কারণে গরুগুলো ঢাকা থেকে ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যার মধ্যে ৩টি মোট ২৭ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এই তিনটি গরুতে অন্তত তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

উন্নত জাত ও উচ্চ মূল্যের গরু পালনের জন্য দেশব্যাপী বেশ খ্যাতি রয়েছে আলমডাঙ্গার কান্তপুর গ্রামের তাজউদ্দিন অ্যাগ্রোর। খামারটির স্বত্বাধিকারী হাজ্জাজ আলী জানান, এবার ঢাকার কোরবানির পশুর হাটে বড় ও মাঝারি আকারের ১৭টি গরু তুলেছিলেন। আশা ছিল ৬০ লাখ টাকায় এগুলো বিক্রি হবে। যার মধ্যে ১৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ৭টি মাঝারি গরু বিক্রি করেছেন। ১০টি হাট থেকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।

হাজ্জাজ বলেন, এসব গরুর গাড়িভাড়া বাবদ ৩৫ হাজার টাকা, প্যান্ডেল ভাড়া ৭৩ হাজার টাকা, নিজের এবং শ্রমিকদের খাওয়া ও মজুরি, সেই সঙ্গে কমদামে ৭টি গরু বিক্রির কারণে অন্তত ৪ লাখ ২১ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে তাঁর।

এর বাইরে আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার নওদা বণ্ডবিল গ্রামের ঠাণ্ডু মিয়া ৩০টি গরুর মধ্যে ১৫টি, ভাংবাড়িয়া ইউনিয়ন সদরের মো. আবু ছদ্দিন ৩০টি গরুর মধ্যে ২৪টি, কালিদাসপুরের পারকুলা গ্রামের মো. জামিল উদ্দিন ৩০টি গরুর মধ্যে ২১টি এবং জামজামি ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের মো. বাদল মিয়া ৩০টি গরুর মধ্যে ৬টিই ফিরিয়ে এনেছেন।