অর্পিত সম্পত্তি
ইজারা নিয়ে বেচাকেনা
যে ২২ জনকে জমির দখলদার দেখিয়ে ইজারা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৮ জনেরই জমি দখলে ছিল না।
যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ভবানীপুর মৌজার মরিচা বাজার এলাকায় এক শতক অর্পিত সম্পত্তির ওপর টিনের ছাপরা তুলে খাবারের হোটেল দিয়েছিলেন বিধবা রুমিচা বেগম (৬০)। মাসে ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে ১২ বছর ধরে তিনি হোটেলটি চালাচ্ছিলেন। বছর দুই আগে এক রাতে তাঁর হোটেলটি ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি জানতে পারেন, সৌমিত্র রায় নামের এক ব্যক্তি তাঁর হোটেল ভেঙে দিয়েছেন। সৌমিত্র রায়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি রুমিচার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু এত টাকা জোগাড় করতে পারেননি রুমিচা। এরপর এক শতক জমি ইজারার জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন করেও ইজারা পাননি রুমিচা।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাশুয়াড়ী গ্রামে বাড়ি রুমিচা বেগমের। এখন তিনি স্বামীর ভিটায় ছোট একটি চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। রুমিচা আবেদন করে জমি ইজারা না পেলেও আবেদন না করেই জমি পেয়েছেন আতাউর রহমান ওরফে লাভলু নামের এক ব্যক্তি। তাঁর বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার চাকই গ্রামে। তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে আফ্রিকার দেশ মালিতে আছেন।
যোগাযোগ করা হলে আতাউর রহমান বলেন, প্রায় এক বছর ধরে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দেশের বাইরে আছেন। মরিচা বাজারে তিনি এক শতক জমি ইজারা পেয়েছেন। এ জন্য সমু ডাক্তারকে (সৌমিত্র রায়) দুই লাখ টাকা দিতে হয়েছে। ইজারা নেওয়ার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। তিনি একসনাভিত্তিক ইজারা পেয়েছেন।
ভবানীপুর মৌজায় দুটি দাগে ৭০ শতক অর্পিত সম্পত্তি এক বছরের জন্য ইজারা নিয়ে আইনজীবী স্বপন কুমার বিশ্বাস তাঁর মামাতো ভাই সৌমিত্র রায়কে দিয়ে প্রতি শতক দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে বিক্রি করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিক্রি হওয়া সেই জমিই আবার ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫৩ শতক জমি ইজারা পেয়েছেন আতাউর রহমানের মতো ২২ জন। আর এ কাজে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) থান্দার কামরুজ্জামান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেজবাহ উদ্দীন সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সৌমিত্র রায়ের বাড়ি অভয়নগর উপজেলা কোদলা গ্রামে। অর্পিত সম্পত্তি বরাদ্দের বিষয়ে সরকারি নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইজারাভুক্ত জমির শ্রেণি, আকার, প্রকার কোনোরূপ পরিবর্তন করা যাবে না। ইজারাদার ইজারা সম্পত্তিতে কোনো রকম দায় সৃষ্টি করতে পারবেন না বা সাব-ইজারা দিতে পারবেন না। জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া খালি জমি ইজারা নিয়ে ঘর তোলা যাবে না।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ভবানীপুর মৌজায় ৩৯, ৪২ ও ৪৩ দাগে ৭০ শতক জমির মালিক ছিলেন সুরমা নাগ। জমির শ্রেণি ছিল গর্ত ও ডাঙ্গা। তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। সর্বশেষ রেকর্ডে ওই জমি সরকারের নামে রেকর্ড হয়। দাগ পরিবর্তন হয়ে হয় ২৪৪ ও ২৪৫। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে করা হয়েছে ধানি জমি। স্বপন কুমার বিশ্বাস ওই জমি কৃষিজমি হিসেবে ইজারা নেন। এরপর বালু দিয়ে ভরাট করে জমিতে কয়েকটি দোকানঘর তুলে সাব-ইজারা দেন।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) থান্দার কামরুজ্জামান বলেন, ‘নানাভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন হতে পারে। জমিতে যাঁদের দখল পেয়েছি, তাঁদের ইজারা দিয়েছি। সৌমিত্র রায় জমি বিক্রি করছেন বা বিদেশে থেকে কেউ জমি বরাদ্দ পেয়েছেন, এমন অভিযোগ কেউ করেননি।’
২০২০ সালে ইজারাদার স্বপন কুমার বিশ্বাস যশোরের জেলা প্রশাসকের কাছে জমির ওপর আধপাকা ঘর নির্মাণের জন্য আবেদন করেন। সেই অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে আধপাকা ঘর নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। ধানি শ্রেণির ৭০ শতক জমির মধ্যে ১ শতক জমি স্থাপনা এবং ৬৯ শতক জমি বাণিজ্যিক হিসাবে ইজারা নবায়ন করা হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর সৌমিত্র রায় ওই জমিতে সাব-ইজারা দেওয়া কয়েকটি দোকান ভেঙে দেন। এরপর তিনি জমি খালি করে বিক্রি করতে থাকেন।
ওই জমি বরাদ্দ পেতে এলাকার অন্তত ৪০ জন আবেদন করেন। উপজেলার ভাটপাড়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ঝর্ণা রানী বিশ্বাস ২৭ জন আবেদনকারীর আবেদন সরেজমিন তদন্ত করে যে ২২ জন জমি কিনেছেন, কেবল তাঁদের নামে জমি দখল দেখিয়ে গত ১৯ মার্চ সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ২০ মার্চ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইজারাদার স্বপন কুমার বিশ্বাস সম্পূর্ণ জমি ভোগদখল না করায় তাঁর দখল করা ১৫ দশমিক ৬৯ শতক জমি বাদে অবশিষ্ট জমির ইজারা বাতিল করে বর্তমান দখলদার ২২ জনের নামে ইজারা দেওয়ার জন্য ইউএনওর কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে সুপারিশ করেন। ২১ মার্চ ইউএনও ওই ২২ জনের নামে ৫৪ দশমিক ৩১ শতক জমি ইজারা অনুমোদন করেন। স্বপন কুমার বিশ্বাসকে আগের ১৫ দশমিক ৬৯ শতক ছাড়াও আরও ১ শতক জমি ইজারা দেওয়া হয়। সৌমিত্র রায়কে ইজারা দেওয়া হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতক।
এ বিষয়ে সদ্যবিদায়ী অভয়নগরের ইউএনও মেজবাহ উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপন কুমার বিশ্বাস ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে জমি হস্তান্তর করেছিলেন। এ ব্যাপারে ডিসি ও এডিসি স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে। স্বপন কুমার বিশ্বাসের ইজারা বাতিল করে জমি দখলে থেকে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ভিপি সম্পত্তির সব নিয়মনীতি মেনেই ইজারা দেওয়া হয়েছে। সৌমিত্র ওই জমির ইজারাদার নন। সুতরাং সৌমিত্রের জমি বিক্রি ও টাকা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে ২২ জন জমির দখলদার দেখিয়ে ইজারা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৮ জনেরই জমি দখলে ছিল না। এমনকি জমির ইজারাদার স্বপন কুমার বিশ্বাসেরও জমি দখলে ছিল না। তবে তাঁর মামাতো ভাই সৌমিত্র রায় জমিতে একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে ইজারাদারের পক্ষে জমি দখলে রেখেছিলেন। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে কর্মরত আতাউর রহমান এবং নড়াইলের সদর উপজেলার সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমকে ‘জাহাঙ্গীর বিশ্বাস’ নামে দখল দেখিয়ে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ওই জমিতে আমার দখল ছিল না। আবেদন করে ১ দশমিক ২৯ শতক জমির ডিসিআর পেয়ে আমি জমিতে দখলে গিয়েছি।’
জমি বরাদ্দ পাওয়া নড়াইলের মির্জাপুর গ্রামের সুজন কাজী বলেন, ‘আমি ও আমার ভাই আজিম কাজী মিলে আড়াই লাখ টাকা করে আড়াই শতক এবং সাড়ে তিন লাখ টাকা করে ১ শতক জমি কিনেছি। মোট দাম ৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে সৌমিত্র রায় ও তাঁর কাকা কুমুদ রায় এবং চাচাতো ভাই প্রবীণ রায়কে ৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা দিয়েছি। এখনো ১ লাখ ৯ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। সৌমিত্র দায়িত্ব নিয়ে বন্দোবস্তর জন্য আবেদন করেছেন। পরে উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে ২৩ হাজার টাকা খাজনা এবং আট হাজার টাকা অফিস খরচ দিয়ে ৩ দশমিক ২৫ শতক জমির ডিসিআর পেয়েছি।’
সৌমিত্র রায় বলেন, ‘আমাদের ডিসিআর কাটা জমিতে বড় বড় গর্ত ছিল। আমি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করে বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করে ঘর করে দিয়েছি। আড়াই লাখ টাকার ওপরে খরচ আছে। কেউ দুই লাখ, কেউ দেড় লাখ করে টাকা দিয়েছেন। লোকজন টাকা দিতে চান না। এ জন্য ইউএনও স্যারকে পাঁচ লাখ, অমুককে সাত লাখ দিতে হবে বলে টাকা আদায় করেছি। এখনো অনেক টাকা বাকি রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জায়গাটা নিয়ে ২০ বছর ধরে আমি একটা যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। ইউএনও স্যার ও এসি ল্যান্ড আমাকে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি তো সব সত্যতা পেয়ে গেছেন। তাহলে আমার কাছে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’