পাশাপাশি মাহফিল ও পূজা, চিড় ধরেনি সম্প্রীতির বন্ধনে

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ বাজারে ৮৫ বছরের পুরোনে সার্বজনীন কালী মন্দিরে চলছে দুর্গাপূজা। গতকাল সন্ধ্যায়
ছবি-প্রথম আলো

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার ব্যস্ততম এলাকার বড়ঘোপ বাজার। বাজারের মধ্যভাগে সর্বজনীন কেন্দ্রীয় কালীমন্দিরে মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসবের মহাসপ্তমী। মণ্ডপে পূজা দেখতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশাপাশির স্থানীয় মুসলমান নারী-পুরুষেরাও এসেছিলেন। পাশেই চলছিল ওয়াজ মাহফিল। মণ্ডপের ঢাকের আওয়াজ আর মাহফিলের বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল পাশাপাশি।

কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার লোকজন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে রীতিমতো গর্ব করেন। দ্বীপে স্মরণকালে কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা ঘটেনি। পীরের দরগা, মসজিদ, মন্দির—সবই রয়েছে এখানে।

২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল হজরত কুতুব উদ্দিনের নামে। দ্বীপের আধ্যাত্মিক পুরুষ মালেক শাহ (র.)-এর দরবার শরিফে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে প্রতিবছর। তেমনি ধুমধাম করে উদ্‌যাপিত হয় দুর্গাপূজাও। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দ্বীপের লোকসংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৮ জন। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ মুসলিম, ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ হিন্দু এবং শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন।

৮৫ বছর আগে দ্বীপের বড়ঘোপ বাজারে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বজনীন কেন্দ্রীয় কালীমন্দির। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় বড়ঘোপ রাধাগোবিন্দ মন্দির, স্টিমারঘাট কালীমন্দিরসহ আরও কয়েকটি মন্দির। তবে পাকিস্তান আমলেও এখানকার মন্দিরে কোনো হামলা হয়নি। এ কারণে এখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদের নিরাপদ ভাবেন সব সময়।

গতকাল বিকেলে বড়ঘোপ বাজারের সর্বজনীন কেন্দ্রীয় কালীমন্দিরে গিয়ে দেখা গেল, সনাতন ধর্মের নারী-পুরুষেরা দুর্গাপ্রতিমা দর্শন শেষে পূজা-অর্চনায় মশগুল। মণ্ডপের বাইরে পাহারায় পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা।

গতকাল বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অন্তত উপজেলার ১২টি মণ্ডপ ঘুরে দেখেন কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক। সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুভরঞ্জন চাকমাসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।

আশেক উল্লাহ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, কুতুবদিয়ার ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির একটা বন্ধন আছে। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে দ্বীপের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন করে আসছেন। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং তাঁদের সংস্কৃতির বিকাশে সরকার ও প্রশাসন খুবই আন্তরিক।

সন্ধ্যায় সর্বজনীন কালীমন্দিরে কথা হয় উপজেলা দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন পরিষদ সভাপতি সজল কুমার শীলের (৫৫) সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্গাপূজা উদ্‌যাপনে তাঁদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে প্রায় ৮৫ বছর আগে। পাকিস্তান আমল এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে এখানকার অনেক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। চলে হত্যাযজ্ঞ।

কিন্তু কোনো মন্দিরে হামলা কিংবা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কোনো মন্দিরে হামলা কিংবা ভাঙচুর হয়নি। হিন্দুরা সংখ্যালঘু হলেও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকতে হচ্ছে না।

মন্দিরের পুরোহিত তাপস চক্রবর্তী (৩৫) বলেন, সাত বছর ধরে তিনি এই মন্দিরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে টানা ২৬ বছর মন্দিরে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন তাঁর বাবা রতন চক্রবর্তী (৫৫)। সাত বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর তিনি দায়িত্ব নেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের সময় বাধার সম্মুখীন হননি।

পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাজীব সেন (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, এবার উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নে (উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী, কৈয়ারবিল, বড়ঘোপ ও আলী আকবর ডেইল) ৪৪টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩১টি ঘটপূজা, ১৩টি প্রতিমাপূজা। ২৪ অক্টোবর দুপুর ১২টার মধ্যে প্রতিমাগুলো বিভিন্ন পুকুর-দিঘি এবং কয়েকটি বড়ঘোপ সমুদ্রসৈকতে বিসর্জন দেওয়া হবে। মণ্ডপের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করছে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান-মেম্বররা।

শান্তিপূর্ণভাবে দ্বীপের সব কটি মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা উদ্‌যাপিত হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা প্রথম আলোকে বলেন, তারপরও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে উপজেলার ১২টি মণ্ডপে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৭৯০ কেজি করে চাল, বড়ঘোপ কেন্দ্রীয় কালীমন্দিরে ১ হাজার ১৩০ কেজি চাল এবং ৩১টি ঘটপূজার প্রতিটিতে ৯০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ওসি শুভরঞ্জন চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, কুতুবদিয়ায় অতীতে মন্দির কিংবা সনাতন ধর্মের লোকজনের ওপর হামলার নজির নেই। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত দ্বীপটির মানুষ এখন পর্যন্ত সম্প্রীতির অটুট বন্ধন ধরে রাখতে পেরেছে, যা দেশের মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে।