নাসিমা, নজিরদের ঋণ বাড়ছে

দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মো. নজির। গত শুক্রবার সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায়প্রথম আলো

তিন মাসের মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। দোকান থেকে কিছু একটা খাওয়ার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরেছে দুই বছরের ছেলেটি। মা নাসিমা আক্তার ঘরে বসে ছেলেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বিছানায় বসে স্ত্রী-ছেলের কথোপকথন শুনছিলেন মো. রজু মিয়া (৫২)। আলাপের শুরুতে এই দম্পতি বললেন, দুই বেলা ঠিকমতো ভাতই জোটে না, এ অবস্থায় ছেলের আবদার মেটাবেন কীভাবে।

গত শুক্রবার বিকেলে নাসিমা ও রজুর সঙ্গে কথা হয় সিলেট নগরের পনিটুলা এলাকায়। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁরা সেখানে একটা খুপরিতে থাকেন। ভাড়া দুই হাজার টাকা। রজু হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত, একরকম বেকার বসে আছেন। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণি আর ছেলেটি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। কয়েক মাস আগেও নাসিমা কয়েকটি বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন, এখন সন্তান জন্ম দেওয়ায় একটি বাসায় কাজ করেন। সেখান থেকে পান ১ হাজার ৯০০ টাকা। এতে তাঁর ছয় সদস্যের সংসার চলছে না।

নাসিমা বলেন, আগের কিছু সঞ্চয় দিয়ে এত দিন চলেছেন। এখন ধারকর্জ শুরু করেছেন। দিন দিন দেনা বেড়েই চলছে। ঘরভাড়া, খাওয়াদাওয়া, সন্তানদের লেখাপড়াসহ প্রতি মাসে পাঁচ–ছয় হাজার টাকা দরকার। অথচ তাঁর আয় ১ হাজার ৯০০ টাকা। স্বামী টুকটাক কাজ করলেও তা নিয়মিত নয়।

নাসিমা আক্তার বলেন, ‘মাছের যে দাম, দু-এক মাসে একবার মাছ কিনে খাইতাম। এখন আর মাছ কিনতাম পারি না। মাংস খাওয়া তো আমরার লাগি আরও কঠিন। চাইল, ডাইলের দাম বাড়ছে। খরচ বাঁচাইতে ভাত খাওয়াও কমাইয়া দিছি। সামনের দিন কেমনে যাইব, বুঝতাছি না।’

দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কারণে নাসিমার মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা সংগ্রাম করে সংসার চালাচ্ছেন। নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার ফুটপাতে ঠেলাগাড়িতে করে ফল বিক্রি করেন মো. নজির (৫৬)। তিনি জানান, ব্যবসা থেকে তাঁর মাসে গড়ে ২৫ হাজার টাকা আয় হয়। এর ভেতরে তাঁকে ঘরভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার ৫০০ টাকা। প্রয়োজন মেটাতে সম্প্রতি তিনি দুটি উন্নয়ন সংস্থা থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। মাসে ঋণের কিস্তি দিতে যায় ৭ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি টাকায় খাওয়াসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটান তাঁরা।

টাকার অভাবে দুই সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে নজির বলেন, ছেলে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। করোনাকালে স্মার্টফোন না থাকায় ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। ফলে পড়াশোনায় গ্যাপ পড়েছে। এখন আবার ক্লাসে পাঠাতে চাইলেও টাকার অভাবে পারছেন না। মেয়ে করোনার সময়ে এসএসসি পাস করলেও টাকার অভাবে কলেজে ভর্তি করাতে পারেননি।

মাছ ও মাংসের দাম বাড়ার কারণে সেসব কেনার সামর্থ্য নেই বলে জানালেন মঞ্জু রানী সরকার (৪৮)। নগরের খরাদিপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় মাঠকর্মীর কাজ করেন। বেতন পান আট হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘বাজারে গেলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। এত দাম জিনিসের। কৃচ্ছ্র করে কোনো রকমে দিন চালাচ্ছি। হঠাৎ চিকিৎসক দেখানোর প্রয়োজন পড়লে ভাই-স্বজনদের কাছ থেকে ধারকর্জ করছি।’