কল চেপে জীবন চলে খালেদার

দোকানে আর মানুষের বাসায় পানি পৌঁছে দিয়ে জীবন চালান খালেদা সরদার। বৃহস্পতিবার সকালে খুলনা শহরের হাজী মহসিন রোড এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কয়েক দিন ধরে খুলনায় তাল পাকা গরম পড়ছে। মাঝভাদ্রের গরমে সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। কোথাও স্বস্তি নেই। বিদ্যুতের খামখেয়ালি অনুপস্থিতি অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও ঝকঝকে রোদ। সকালের রোদ্দুরও যেন কাঁটার মতো বিঁধছে শরীরে। শহরের রাস্তায় ছোট ছোট দলে হাঁটা মানুষ ঘেমেনেয়ে একাকার।

হাজী মহসিন রোডের সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের ফরেস্ট কলোনির ফটকের ঠিক বিপরীতে একটা গভীর নলকূপ। কলের পাশে একটি ছোট পানি টানার ট্রলি। ট্রলির ওপর সাজানো বেশ কয়েকটি কলস। সেখান থেকে একেকটা করে কলস নিয়ে পানি ভরছেন একজন নারী। কল চেপে পানি ভরার সময় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তাঁর মুখে।

এক এক করে আটটা কলস ভরে কলপাড়ে একটু বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালেন। কথা বলে জানা গেল, তাঁর নাম খালেদা সরদার। বয়স ৪২-৪৩ হবে। সাতক্ষীরার আশাশুনির আনুলিয়া ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামে বাড়ি ছিল খালেদার। বাবার সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অন্যের জমিতে কাজ করে বাবা-ভাইদের সংসার চলত। ৮ ভাইবোনসহ ১০ জনের সংসারে কখনো স্বাচ্ছন্দ্যের দেখা মেলেনি। এক আত্মীয়ের সঙ্গে খুলনা শহরে চলে আসেন খালেদা। বয়স তখন তাঁর ৮ কি ৯ বছর। এরপর বাসাবাড়িতে কাজ শুরু। একসময় সংসার হয় খালেদার। সেই সংসার সাত–আট বছর টিকে ছিল। একটা সন্তান হয়েছিল, মারা গেছে। এখন খালেদা একা থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন দোকান ও বাসায় পানি দেওয়াকে।

১০ বছর ধরে এ কাজ করছেন খালেদা। প্রথম দিকে কোমরে করে পানি টানতেন। পরে বেয়ারিংয়ের চাকার একটা কাঠের ট্রলি তৈরি করিয়ে নেন। বছর পাঁচেক আগে হাজার দশেক টাকা দিয়ে একটা লোহার পাতের ট্রলি তৈরি করেছেন। এতে আটটা কলস ধরে। কিছুদিন আগে সেই ট্রলির পাত, চাকা পরিবর্তন করতে হয়েছে। মেরামতের পেছনে আট হাজার টাকা চলে গেছে তাঁর।

খালেদা বলেন, ‘বাবার যা টুকটাক ছিল, সব খোলপেটুয়া নদীর পেটে চলে গেছে। নদীর পারে এখন কোনোমতে ভাইয়েরা বাস করেন। ছোটবেলাতেই অভাবের তাড়নায় শহরে চলে আসি। সেই থেকে কাজ করে খাই। একসময় বিয়ে হয়, সংসার হয়। তখনো কাজ করে খেতে হয়েছে। এখনো কাজ করেই খেতে হচ্ছে। বছরখানেক আগে রাস্তায় রডের ওপর পড়ে ১৫-২০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এরপর অনেক দিন কাজ করতে পারিনি। এখনো কল চাপতে, ট্রলি ঠেলতে কষ্ট হয়; তবে ওসব কষ্ট আমলে নিলে চলে না। যত দিন শরীর ভালো থাকবে, কাজ করে যেতেই হবে।’

এরপর অনুরোধের সুরে খালেদা বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে অসহায় নারীদের পানি টানার ট্রলি দিয়েছে। সেগুলো খুব মজবুত। চলে বেশি। ঠেলতে কষ্ট হয় না। একটা পেলে কষ্টটা কমত। আপনারা যদি একটা ব্যবস্থা করে দিতেন!’

আলাপে আলাপে জানা গেল, ফজরের আজানের আগে উঠে দিন শুরু হয় খালেদার। বেলা ১১টার মধ্যে দোকানে পানি দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যায় তাঁর। এরপর বাসায় পানি দেন। এক কলস পানি পৌঁছে দিয়ে পান পাঁচ টাকা। সেই হিসাবে তাঁর আয় প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ টাকা। শুক্রবার রোজগার বেড়ে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় দাঁড়ায়। হাজী মহসিন রোডের আরজান আলী লেনের খুব ছোট একটা রুমে থাকেন খালেদা। বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিয়ে খরচ পড়ে যায় ১ হাজার ২০০ টাকার মতো। নিজেই রান্না করে খান। মেনুতে বেশির ভাগ সময় থাকে শাকপাতা, আলুভর্তা, কখনো ডাল–চাল মিলিয়ে একটু খিচুড়ি। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি রাখতে মাংস কোনো মাসে একবার, আবার কোনো মাসে খান না। মাছের বেলাতেও তাই।

কয়েক মাস আগে খালেদার মা মারা গেছেন, তবে বাবা আছেন। স্বল্প এ আয় থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠান। খালেদা বলেন, ‘দোকানে পানি দিয়ে যে আয় হয়, তাতে আমার থাকা-খাওয়ার খরচের টাকার বেশির ভাগ উঠে যায়। আর আমি সাতটা বাসায় পানি দেই। সেখান থেকে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো আসে। সেখান থেকে নিজে কিছু জমাই আর বাবা ও এক ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছে, তাঁদের জন্য কিছু টাকা পাঠাই। নিজে যেভাবেই চলি না কেন, দায়িত্ব বলে তো একটা জিনিস আছে!’

টাকা জমিয়ে কী করবেন, জানতে চাইলে খালেদা বলেন, ‘শরীর তো এক রকম যায় না। কত রকম বিপদ–আপদ আসে! টাকা না থাকলে চলবে কী করে। আর শহর এখন ভালো লাগে না। কল চাপতে চাপতে হাতে কড়া পড়ে গেছে। শারীরিক নানা অসুস্থতায় বাসাবাড়িতে কাজ করতে পারি না। অল্প করে কিছু টাকা জমাচ্ছি। ওপরওয়ালা চাইলে আরও কয়েক বছর পর গ্রামে ফিরে কিছু করা যায় কি না, তা দেখব।’