১০ গ্রামের ভরসা বাঁশের সাঁকো

সাঁকোটি স্থানীয় জনগণ তাঁদের প্রয়োজনে ২০১২ সালে প্রথম তৈরি করেন। এরপর প্রতিবছরই এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার ১০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ আজও বাঁশের সাঁকোর ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি উপজেলার জোড়খালী ইউনিয়নের ফুলারপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার জোড়খালী ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের আনুমানিক ২০ হাজার মানুষের যাতায়াতে আজও একমাত্র ভরসা একটি বাঁশের সাঁকো। সাঁকোটি এলাকার জনগণ নিজেদের অর্থায়ন ও স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করেছেন।

উপজেলার জোড়খালী ইউনিয়নের ফুলারপাড়া এলাকার উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনার শাখা নদী। সেখানে সেতু না থাকায় দুর্ভোগের অন্ত নেই। কৃষি এই এলাকার মানুষের প্রধান ভরসা। তাঁরা শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছেন। এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে বাঁশের দীর্ঘ সাঁকো তৈরি করে নিয়েছেন।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যমুনা শাখা নদীর ওপর স্থানীয় জনগণ নিজ উদ্যোগে প্রায় ১০ বছর আগে একটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করেন, যা দুই বছর পর পর নতুন করে নির্মাণ করতে হয়। সাঁকোটি তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে সংস্কারও করছেন। ওই শাখা নদীর দক্ষিণ পাশে ফুলারপাড়া, রৌহা, নান্দিনা, জামিরা, খামারমাগুরা এবং উত্তর পাশের পাটাদহ, কয়রা, বাশদাইর, কলাদহ, কুকুরমারি—এই ১০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ ওই সাঁকোটি ব্যবহার করেন। তাঁদের প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, উপজেলা শহর ও হাটবাজারে কাজের জন্য সাঁকোটি পার হতে হয়।

‘যমুনার শাখা নদীরটির কারণে ওই সব গ্রামের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় এই শাখা নদীটির সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে ওইসব গ্রামের মানুষ নৌকায় যাতায়াত করতেন। পরে গ্রামবাসীর নিজেদের উদ্যোগে ওই সাঁকোটি নির্মাণ করে। বছরের পর বছর ধরে এতগুলো গ্রামের মানুষ এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করে আসছেন। রাতের বেলায় টর্চ দিয়া পা টিপে টিপে চলাচল করতে হয়। কয়েক মাস আগে আমি নিজে মোটরসাইকেল নিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।’
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ফুলারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও জোড়খালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক

সম্প্রতি সরেজমিনে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাঁকোটি স্থানীয় জনগণ তাঁদের প্রয়োজনে ২০১২ সালে প্রথম তৈরি করেন। এরপর প্রতিবছরই এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তবে দুই বছর পর বাঁশের খুঁটি ও চাটাই পরিবর্তন করা হয়। এর সবই চলে স্থানীয় জনগণের আর্থিক সহায়তায়। চলতি বছরের মে মাসে প্রায় ১ লাখ টাকা ব্যয়ে সাঁকোটি সংস্কার করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, লোকজন সাইকেল ও ভ্যানগাড়ি নিয়ে হেঁটে সাঁকো পার হচ্ছেন। অনেকে আবার পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরাও পায়ে হেঁটে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন। সাবধানে চলাচল করছেন সবাই। কারণ, সাঁকোর ওপর থেকে অনেকে পড়ে আহত হয়েছেন। একটু অন্যমনস্ক হলে যেকোনো সময় পড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এই সাঁকো দিয়ে চলাচলে এলাকার জনগণ নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন। ফুলারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও জোড়খালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনার শাখা নদীরটির কারণে ওই সব গ্রামের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় এই শাখা নদীটির সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে ওইসব গ্রামের মানুষ নৌকায় যাতায়াত করতেন। পরে গ্রামবাসীর নিজেদের উদ্যোগে ওই সাঁকোটি নির্মাণ করে। বছরের পর বছর ধরে এতগুলো গ্রামের মানুষ এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করে আসছেন। রাতের বেলায় টর্চ দিয়া পা টিপে টিপে চলাচল করতে হয়। কয়েক মাস আগে আমি নিজে মোটরসাইকেল নিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।’

ফুলারপাড়া গ্রামের আবদুল লতিফ মিয়া বলেন, ‘গ্রামগুলো কৃষিনির্ভর। নানা রকমের কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কৃষিপণ্যের সঠিক দাম পাওয়া যায় না। একটি সেতুর কারণে ওই সব গ্রামে তেমন কোন উন্নয়নও হয়নি। গ্রামগুলো এখনো অবহেলিত। কোনোরকমে যাতায়াতের জন্যে এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে বাঁশের দীর্ঘ সাঁকো তৈরি করে নিয়েছেন।’

জামিরা গ্রামের কৃষক রহমত আলী বলেন, ‘আমাগো দুঃখকষ্টের কথা কেউ শোনে না। বর্ষার সময় সাঁকোটি পার হওয়া অনেক কষ্টের। নদীভরা পানি থাকে। তখন সাঁকোটি নড়বড়ে হয়ে যায়। আমগরে কষ্ট কেউ বুঝে না। বহু বছর ধরে শুনি, এখানে সেতু হবে। কিন্তু কখনো আর সেতু হলো না। আর হবে কি না, সেটাও জানি না।’

জামালপুরের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সায়েদুজ্জামান সাদেক বলেন, ওই স্থানে ৯৮ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রস্তাব পাস হলে সেখানে একটি সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হবে।