ভয়াল ২৯ এপ্রিলের যে স্মৃতি আজও থমকে দেয়

৩৩ বছর আগে ২৯ এপ্রিলের ঝড়ে পাতিলে ভেসে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে এসেছিলেন মুসলিম উদ্দিন। নিজের বাবা–মা পরিবারের কোনো কথাই তাঁর মনে নেই। গত শনিবার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর আশ্রয়ণ প্রকল্পেপ্রথম আলো।

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ৩৩ বছর আগে এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপগুলো লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছিল। জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গিয়েছিল অনেক এলাকা। কেবল সরকারি হিসাবে এই ঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের মৃত্যুর কথা জানা যায়। প্রায় সমপরিমাণ মানুষ আহতও হন। চিরতরে ঘরবাড়িহারা হন হাজারো মানুষ। সেই কালরাত্রির নানা ঘটনা এখনো উপকূলীয় এলাকার লোকের মুখে মুখে ফেরে।

পাতিলে ভেসে আসা এক শিশু

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নের বাসিন্দা মুসলিম উদ্দিন এখন টগবগে যুবক। এলাকার লোকজন তাঁকে তুফান হিসেবে চেনেন। পেশায় তিনি ভাড়ায় চালিত কারচালক। আছে স্ত্রী-সন্তানও। অথচ তিনি এখনো জানেন না, তাঁর মা-বাবা কে কিংবা তাঁদের বাড়িঘর কোথায় ছিল।

জানতে চাইলে হাসিমুখেই নিজের কথা বলেন মুসলিম উদ্দিন। ১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেসে আসেন তিনি সীতাকুণ্ডে। একটি বড় পাতিলের ভেতর রেখে তাঁকে কেউ ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন দেড় থেকে দুই বছরের শিশু।

৩৩ বছর ধরে সীতাকুণ্ডেই বসবাস করছেন মুসলিম উদ্দিন। নিজের মা–বাবা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, জানেন না তিনি। তাঁদের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় কষ্টের অনুভূতি তাঁর জীবনে।

তিন কন্যাসন্তানের বাবা মুসলিম গাড়ি চালিয়ে ভালো আয় করেন। সংসারও চলছে ভালোভাবেই। তাঁর বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, মেজ মেয়ে সুমাইয়া আক্তার পঞ্চম শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে সানজিদা আক্তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। সম্প্রতি আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের কাছ থেকে একটি ঘরও পেয়েছেন তিনি।

গত শনিবার দুপুরে উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জঙ্গল ভাটিয়ারী পাহাড়ের ভেতরে স্থাপিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে বসে কথা হয় মুসলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগের কোনো স্মৃতি এখন আর মনে নেই। তবে পাতিলে করে ভেসে আসা ও তার পরের কথাগুলো এলাকার মানুষের মুখে শুনে আসছেন।

মুসলিম উদ্দিন বলেন, শুনেছেন, তিনি বড় একটি পাতিলের ভেতরে করে ভেসে ভাটিয়ারী উপকূলে আসেন। ঘূর্ণিঝড়ে পরদিন তিনি যখন পাতিলের ভেতর ভয়ে কান্না করছিলেন, তখন জেলে সম্প্রদায়ের এক লোক তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তাঁরা তাঁকে রাখেননি। পরে তাঁকে ভাটিয়ারী বাজারের উত্তর পাশে তেলীবাড়ি এলাকার স্থানীয় একজন মুসলিম পরিবার নিয়ে যায়। কিন্তু তাঁর একেবারে ছোটবেলার কথা তেমন মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে, তার বয়স যখন সাত থেকে আট বছর, তখন তাঁর পালক বাবার পরিবারে অভাব–অনটন দেখা দেয়। তখন তিনি ভাটিয়ারী কাঁচাবাজারে ঘুরে ঘুরে পলিথিন (বাজারের ব্যাগ) বিক্রি করতেন। এভাবে একরকম পথশিশুর মতো হয়ে যান। পরে নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। এখন স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাঁর।

ভাটিয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাব্বির আহম্মদ চৌধুরী বলেন, মুরব্বিদের কাছে তাঁরা শুনেছেন, বন্যার পানিতে পাতিলে করে ভেসে এসেছিলেন মুসলিম উদ্দিন। আজ পর্যন্ত তাঁর মা–বাবা দাবি করে কেউ আসেননি। মুসলিমকে তুফান নামে ডাকেন স্থানীয় লোকজন।

মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখনো আমার জন্মদাতা মা–বাবার পরিচয় পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁরা ঘূর্ণিঝড়ে বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, তা জানি না। বেঁচে থাকলে হয়তো একদিন দেখা পেয়ে যাব। তাঁদের একনজর দেখতে চাই, যাঁরা নিজের কথা না ভেবে আমার বাঁচার জন্য বুদ্ধি করে বন্যার পানিতে বড় পাতিলে ভাসিয়েছেন।’
ভাটিয়ারী ইউপির চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মুসলিম উদ্দিনের বিষয়টি এলাকার সবাই জানেন। জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় মা–বাবা হিসেবে স্থানীয় এক দম্পতির নাম লিখলেও তাঁরা তাকে লালন-পালন করেননি। তাৎক্ষণিকভাবে ওই নাম ব্যবহার করা হয়েছিল।

কুতুবদিয়ার ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর বেদনা

২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল যেসব এলাকার, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ছিল তার শীর্ষে। ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ৯৯ দশমিক ৭৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের হাজারো মানুষের ঘরবাড়ি। প্রাণ হারান অন্তত ৪৫ হাজার মানুষ।

প্রলয়ংকরী সেই ঘূর্ণিঝড়ে মেয়েকে হারিয়েছেন উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল ওয়াহেদ। ঘূর্ণিঝড়ে বিলীন হয় তাঁর দুই একর ধানি জমি ও ৪০ শতক জমিতে নির্মিত টিনশেডের বসতবাড়ি। আবদুল ওয়াহেদের বয়স এখন ৮৬। জন্মের পর থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম ওয়াহেদের। এই জীবনে তিনি ৫০টির বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখেছেন বলে জানান। আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন। চোখের সামনে পানিতে ভেসে এতগুলো মানুষের মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। সেদিন তিনি পরিবারের চারজনকে নিয়ে নারকেলগাছ আঁকড়ে ধরে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তখন টেকসই বেড়িবাঁধ থাকলে এত প্রাণহানি ঘটত না।

ঘূর্ণিঝড়ে তিন ছেলেমেয়েকে হারিয়েছেন হাজি মফজল মিয়া গ্রামের আরেক কৃষক আলী হোসেন (৫৬)। তখন তাঁর ঘর ছিল সমুদ্রের দুই কিলোমিটারে। ঘূর্ণিঝড়ে ঘরটি বিলীন হওয়ার পর বেড়িবাঁধের পাশে নতুন ঘর তৈরি করেন। সেটিও ভেঙে গেলে আরেকটি ঘর তৈরি করেন। গত ২৪ বছরে এ রকম চারটি ঘর হারিয়ে দিশাহারা আলী হোসেন বলেন, ‘একটি টেকসই বেড়িবাঁধের আশায় ৩৩ বছর অপেক্ষা করেছি। সেই আশা ছেড়ে দিয়েছি।’

২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছাসে বিলীন হয়েছিল কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া পাড়ার কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ৩৩ বছরেও সেখানে বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি
ছবি-প্রথম আলো

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজারের একজন কর্মকর্তা বলেন, দ্বীপের চার পাশে এখন পাউবোর ৪০ কিলোমিটার মাটির বেড়িবাঁধ আছে। উপকূল ঘিরে উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের বাঁধের নাম সুপার ডাইক।

প্রস্তাবিত সুপার ডাইক চলতি সালেই বাস্তবায়ন সম্ভব জানিয়ে কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, কক্সবাজার থেকে ফেনী পর্যন্ত ৬৪২ কিলোমিটারের সুপার ডাইক প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি ও অর্থসহায়তা দিচ্ছে নেদারল্যান্ডস ও চীন।

পাউবো সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ফেনী থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী পর্যন্ত ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ১৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কুতুবদিয়াতে সুপার ডাইক হবে ৬৩ কিলোমিটার।