অছাত্র-বিবাহিতদের দিয়ে চলছিল বরিশাল ছাত্রলীগের কমিটি
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের যে আহ্বায়ক কমিটি গতকাল সোমবার রাতে বিলুপ্ত করা হয়েছে, তা অগঠনতান্ত্রিকভাবে করা হয়েছিল বলে পদবঞ্চিত নেতারা দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, এই কমিটি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। সংগঠনের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে অছাত্র ও বিবাহিতদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ নিয়ে লাগাতার কয়েক দিন বিক্ষোভ হলেও কমিটি বাতিল হয়নি। বরং তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি ১০ মাস ধরে চলছে। অবশেষে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর কর্মীদের ওপর হামলার জেরে এই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক অন্তত চারজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ওই কমিটি ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ, অগঠনতান্ত্রিক। এমন কমিটির নজির ছাত্রলীগে নেই।
বরিশাল সিটির বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁর সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ। তাঁর চাচা খায়ের আবদুল্লাহ দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনী কার্যক্রমে দেখা যায়নি তাঁর কর্মী–সমর্থকদের। বরং তাঁর কর্মীদের বিরুদ্ধে খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়া কর্মীদের হুমকি দেওয়া এবং তাঁদের ওপর হামলা করার অভিযোগ রয়েছে।
৩২ সদস্যের ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রত্ব না থাকা বিবাহিত রইস আহম্মেদ ওরফে মান্না। তিনি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত। রইস আহম্মেদের বিরুদ্ধে গত রোববার সন্ধ্যায় খায়ের আবদুল্লাহর তিন কর্মীকে পেটানোর অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ওই দিন মধ্যরাতেই সহযোগীসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর গতকাল সোমবার রাতে মহানগরের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, সাংগঠনিক গতিশীলতা আনার জন্য বরিশালের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এত দিন পর হঠাৎ বিলুপ্তির কারণ জানতে চাইল তিনি বলেন, ‘আমরা ছাত্রলীগকে একটি পরিশুদ্ধ সংগঠনে পরিণত করতে চাই। এ জন্য সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া ওই কমিটি ছিল তিন মাসের। তাই সেটা বিলুপ্ত করা হয়েছে।’
মহানগর ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত কয়েকজন নেতা বলেন, ৩২ সদস্যের ওই কমিটি গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে করা হয়েছিল। কারণ, কমিটির আহ্বায়ক রইস আহম্মেদ দুই সন্তানের বাবা। তিনি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন। এসএসসির সনদ অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স ছিল ৩২ বছর। তালিকার ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাইনুল ইসলাম পদ পাওয়ার এক বছর আগে বিয়ে করেন। এসএসসির সনদ অনুযায়ী ওই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০ বছর। দুই নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান ওরফে শাকিল বিয়ে করেন গত বছরের ৩১ জানুয়ারি। তাঁর বয়সও ৩০ বছরের কাছাকাছি। এ ছাড়া আহ্বায়ক কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর-গ-এ বলা আছে, কোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী (৫-এর-ক উপধারা অনুযায়ী) ছাত্রলীগের কর্মকর্তা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হতে পারেন। বিবাহিত, ব্যবসায়ী ও চাকরিতে নিয়োজিত ছাত্রছাত্রী ছাত্রলীগের কর্মকর্তা হতে পারবে না। গঠনতন্ত্রের এই ধারা মহানগর ছাত্রলীগের এই তিন নেতার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি বলে পদবঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ।
মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক দুজন নেতা অভিযোগ করেন, কমিটিতে যাঁদের স্থান দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সবাই বরিশালের সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠজন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তিনি যা সুপারিশ করেছেন, সেই অনুযায়ী আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে কোনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বিলুপ্ত কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি বিলুপ্ত করার আগে আমাদের কোনো ধরনের ওয়ার্নিং দেওয়া হয়নি। যদি আমাদের কেউ অপরাধ করে, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া যেত। পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে নৌকার বিজয় চায় না, চায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে, দলকে ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী করতে।’
বিবাহিত ও ছাত্রত্ব না থাকার বিষয়ে মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘১১ বছর মহানগরে কোনো কমিটি ঠিক না। এই ১১ বছর আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এ জন্য হয়তো আমাদের ছাত্রত্ব শেষ। আর আমরা সবাই বিবাহিত এটা বলা ঠিক হবে না। আহ্বায়ক বিবাহিত। আমরা দুজন যুগ্ম আহ্বায়কের ওই সময় এনগেজমেন্ট হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আমাদের ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন। আমরা ধৈর্যধারণ করছি। তবে মূল কথা আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার।’ এ বিষয়ে ঢাকায় অবস্থানরত সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগযোগ করা হলেও তিনি ধরেননি।
সর্বশেষ ২০১১ সালে তিন সদস্যের বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ওই তিনজনকে দিয়ে মহানগর ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়। ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান ও ২০২১ সালের ২৫ মে সভাপতি জসীম উদ্দিনকে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের অভিযোগে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অভিযোগ আছে, ওই দুজন প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী ছিলেন। শওকতের মৃত্যুর পর বরিশালের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য চলে যায় বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর হাতে। এতে জসীম ও অসীম কোণঠাসা হয়ে পড়েন। মামলা-হামলার ভয়ে একপর্যায়ে তাঁরা বরিশাল ছাড়েন।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতা অসীম দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। কিন্তু বরিশালে আহ্বায়ক কমিটির নামে যে কমিটি করা হয়েছিল, তার নজির দেশের কোথাও নেই। ওই কমিটি ছাত্রলীগকে কলঙ্কিত করেছে, বরিশালে সংগঠনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা এটা অনুমোদন দিয়ে ঠিক করেননি। ওই কমিটি আগেই বিলুপ্ত করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা সাদিক আবদুল্লাহর রোষানলে পড়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন সিটি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। নির্বাচনের পর প্রকৃত ছাত্রদের নিয়ে একটি কমিটি করে ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
এদিকে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক রইস আহম্মেদকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডাকে মহানগর আওয়ামী লীগ। সংবাদ সম্মেলনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর ওই গ্রেপ্তার ও হামলার ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে তিনি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।
রইসের পক্ষ নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেছিলেন, ‘যে ঘটনায় পুলিশ রইসকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে, সেই ঘটনাস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যেও রইস ছিলেন না। এমনকি ঘটনা সম্পর্কিত কোনো ভিডিও ফুটেজও কেউ উত্থাপন করতে পারেননি। আমরা মহানগর আওয়ামী লীগ এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছি।’
কমিটি বিলুপ্তির বিষয়ে জানতে আজ দুপুরে তাঁকে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।