‘আমার মামা কী দোষ করছিল, এইবায় পুইড়া মরতে হইছে’

ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত রশিদ ঢালীর লাশের অপেক্ষায় স্বজনেরা। বাড়ির সামনে প্রস্তুত রাখা হয়েছে খাটিয়া। বুধবার সকালে নেত্রকোনা শহরের নাগড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

‘মামা কোনো দিনও কালা মুহে মাইনষেরে একটা কথা কইয়া দেখছে না। মুহে হাসিডা লাইগ্গা থাকত। সারা জীবন মাইনষের বিপদে-আপদে পাশে গিয়া দাঁড়াইছে। রাজনীতি করতে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করছে, কিন্তু হাসি ছাড়া কোনো কথা কইছে না। কারও মনে কোনো কষ্ট দিছে না। তাইলে আমার মামা কী দোষ করছিল? এইবায় (এভাবে) পুইড়া মরতে হইছে তারে? আল্লাহ যেন এরারে (নাশকতাকারী) কোনো দিন ক্ষমা না করে।’

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মো. রশিদ ঢালীর (৬৫) ভাগনে মো. হানিফ মিয়া (৪৩) এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন। আজ বুধবার বিকেলে হানিফের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আর কোনো দিন আমি মামা কইয়া ডাকতে পারতাম না। সারা জীবনের লাইগ্গা মামা গেছে গা। আল্লাহ যেন তাঁরে বেহেশত নসিব করুন।’

রশিদ ঢালী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ও পৌর বিএনপির বর্তমান সদস্য ছিলেন। শহরের বড় বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকান আছে।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে গতকাল মঙ্গলবার ভোরের দিকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনটির পুড়ে যাওয়া একটি বগি থেকে মা, শিশুসন্তানসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁদেরই একজন নেত্রকোনা শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা মো. রশিদ ঢালী। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নেত্রকোনা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ও পৌর বিএনপির বর্তমান সদস্য ছিলেন। শহরের বড় বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকান আছে। স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার।

বুধবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে নাগড়া মূল রাস্তার পাশে রশিদ ঢালীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আধপাকা ঘরের দরজার সামনে খাটিয়া সাজানো। বাসার ভেতরে আঙিনাজুড়ে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা জড়ো হয়েছেন। ঘরের ভেতরে স্ত্রী-মেয়েসহ কয়েকজন নারী কান্নাকাটি করছেন। খাটিয়ার কাছে কয়েকজন প্রতিবেশী ও স্বজন লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আরও পড়ুন
রশিদ ঢালীকে কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেননি তিনি। কেউ মারা গেলে সবার আগে তিনি এগিয়ে যেতেন। এমন মানুষের এভাবে মৃত্যু তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।
নিরাময় সরকার, প্রতিবেশী ব্যাংক কর্মকর্তা
নিহত রশিদ ঢালী
ছবি: সংগৃহীত

নিহতের ছোট ছেলে এনামুল ঢালী জানান, বড় ভাই মামুনের ডিএনএ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পর বেলা তিনটার দিকে বাবার লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। তাঁরা লাশ নিয়ে নেত্রকোনার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। লাশ পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যেতে পারে।

স্বজনেরা জানিয়েছেন, দোকানের কাপড় কিনতে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন রশিদ ঢালী। পৌনে ১২টার দিকে নেত্রকোনা বড় স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন। ট্রেনে উঠে স্ত্রীকে ফোন করে জানান।

আরও পড়ুন

এনামুল ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আব্বা সর্বশেষ সোমবার রাত একটার দিকে মামুন ভাইকে ফোন কইরা জানান, তিনি ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌঁছেছেন। আমরা যেন চিন্তা না কইরা ঘুমাইয়া পড়ি। মঙ্গলবার সকালে ঘুম থাইক্কা উইঠা ফেসবুকে দুর্ঘটনার খবর দেইখ্যা আব্বারে ফোন দিতাছি। আব্বা তো ওই ট্রেনে আছিল। তারে পাইতাছি না। পরে আব্বার মহাজনদের ফোন দিছি, তারাও আব্বারে পাইতাছে না। তখন ঢাকায় আমার এক মামাতো ভাইকে ফোন দিছি। সেই ভাই ঢাকা মেডিকেলে গিয়া লাশ পাইছে। কিন্তু লাশ আনতে অনেক ঝামেলা পোয়ানি লাগছে। ডিএনএসহ বিভিন্ন পরীক্ষা কইরা আজ বিকালে লাশ দিছে।’

রশিদ ঢালীর লাশ বাড়িতে পৌঁছানোর পর জানাজা কখন হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন স্বজনেরা। শহরের সাতপাই কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন নিহতের ভাগনে মো. হানিফ মিয়া।

আরও পড়ুন

রশিদ ঢালী হাস্যোজ্জ্বল ও সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। মানুষের বিপদে এগিয়ে যেতেন। রশিদের প্রতিবেশী ব্যাংক কর্মকর্তা নিরাময় সরকার বলেন, তাঁকে কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেননি। কেউ মারা গেলে সবার আগে তিনি এগিয়ে যেতেন। এমন মানুষের এভাবে মৃত্যু তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।

প্রতিবেশী জেলা পূজা ‍উদ্‌যাপন কমিটির সভাপতি জ্ঞানেশ সরকার বলেন, রশিদ ঢালী খুবই হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিলেন। তাঁর এমন মৃত্যুর খবর শুনতে হবে, তাঁরা ভাবেননি। তিনি নাশকতাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

নেত্রকোনা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ভোররাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়ে যাওয়া বগি দেখছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। গতকাল রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে
ছবি: প্রথম আলো

রশিদ ঢালীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. আনোয়ারুল হক ও সদস্যসচিব মো. রফিকুল ইসলাম হিলালী। কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তাঁরা নিহতের আত্মার শান্তি কামনাসহ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং ঘটনা তদন্ত করে বিচারের দাবি করেন।

এদিকে ট্রেনে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদে আজ বেলা ১১টার দিকে শহরের মোক্তারপাড়া এলাকায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ এমরানের পরিচালনায় বক্তব্য দেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান, জেলা সুজনের সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল, জেলা উদীচীর সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক প্রমুখ।

আরও পড়ুন