বন্ধুর মাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে খুন হলেন দুই তরুণ

চুয়াডাঙ্গায় খুন হওয়া মামুন অর রশিদ ও সজল আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

দোকানের কর্মচারী রিয়ন প্রতি গজ ছিটকাপড়ের দাম চেয়েছিলেন ৮৫ টাকা। ক্রেতা ছামেনা বেগম দিতে চেয়েছিলেন ৮০ টাকা। দরদাম করায় ছামেনা বেগমকে অপমান করে দোকান থেকে বের করে দেন ওই কর্মচারী। আর বন্ধুর মায়ের এমন অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়েই খুন হন সজল আহমেদ ও মামুন অর রশিদ নামের দুই তরুণ।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ভালাইপুর বাজারে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। সরেজমিন অনুসন্ধান এবং পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জোড়া খুনের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিন ঘটনাস্থল

গতকাল রাতের জোড়া খুনের পর সদর উপজেলার ভালাইপুর বাজারের চিরচেনা দৃশ্য বদলে গেছে। এই বাজারেরই মণ্ডল মার্কেটে আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গার্মেন্টসের এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই খুন হয়েছেন সজল ও মামুন। সাধারণত যে বাজারটিতে প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাঁচামালের জমজমাট বেচাকেনা চলে, সেখানে আজ বুধবার সাপ্তাহিক হাটের দিনেও বেলা ১০টায় অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল।
বাজারের যেসব দোকান আজ খুলেছে, সেসব দোকানের মালিক-কর্মচারী এবং বাজারে আসা সাধারণ মানুষের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। জোড়া খুনের প্রসঙ্গে বাজারের ব্যবসায়ীদের কেউই সরাসরি মন্তব্য রাজি হননি। জোড়া খুনের প্রতিশোধ হিসেবে হামলার শিকার হওয়ার এবং পুলিশি হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে তাঁদের মনে। ঘটনাস্থল ও আশপাশে পোশাক পরে এবং সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ে।

৫ টাকা নিয়ে বিরোধ

জোড়া খুনের পর কারণ হিসেবে সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে ভালাইপুর বাজারের আশরাফুল বস্ত্রালয় অ্যান্ড গার্মেন্টসে গৃহবধূ ছামেনা খাতুনের ছিটকাপড় কিনতে যাওয়া ও দরদাম করায় অপমান করে বের করে দেওয়ার বিষয়টি। আজ সকালে ভালাইপুর গ্রামের বাড়িতে কথা হয় ছামেনা খাতুনের সঙ্গে। ছামেনা জানান, গতকাল বিকেলে দোকানটিতে তিনি ছিটকাপড় কিনতে যান। একটি ছিটকাপড় পছন্দ হলে দোকানের কর্মচারী রিয়ন প্রতি গজ ৮৫ টাকা করে দাম চান। ছামেনা ৮০ টাকা করে দিতে চাইলে ওই কর্মচারী মারমুখী আচরণ করেন এবং তাঁকে (ছামেনা) অপমান করে দোকান থেকে বের করে দেন। সে সময় দোকানমালিক আশরাফুল দোকানে ছিলেন না। এরপর ছামেনা খাতুন বাড়িতে যান এবং ছেলে টিপু সুলতানকে বিষয়টি জানান। এ ঘটনা শুনে টিপু সুলতান সন্ধ্যায় ওই দোকানে যান এবং দোকানের মালিকের উপস্থিতিতে কর্মচারী রিয়ন ওই ঘটনায় মাফ চাইলে তা মীমাংসা হয়ে যায়।

ছামেনা খাতুনের অপমানের বিষয়টি জানতে পেরে টিপু সুলতানের বন্ধু সজল ও মামুন তাঁদের বাড়িতে ছুটে আসেন। এরপর তাঁরা আরও কয়েকজনকে নিয়ে রাতেই সদর উপজেলার হুচুকপাড়া গ্রামে গিয়ে ওই দোকানের কর্মচারী রিয়নকে মোটরসাইকেলে করে তুলে নিয়ে আসেন। ভালাইপুর বাজারে পৌঁছালে হুচুকপাড়ার  আলাউদ্দিনের ছেলে আকাশ, মুছা করিমের ছেলে শান্তি মিয়া, ওসমান গনির ছেলে সানোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীরসহ একদল লোক তাঁদের গতিরোধ করেন। এ সময় কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে তাঁরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে সজল ও মামুনের ওপর হামলা চালান। ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে সজলের পেট ও মামুনের বুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।

স্থানীয় লোকজন ও চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতায় আহত ব্যক্তিদেরকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক হাসানুর রহমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সজল আহমেদকে তাৎক্ষণিক মৃত ঘোষণা করেন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুন অর রশিদ মারা যান।

সজলের ছেলে রাফিনের কান্না থামছে না

দেড় বছরের শিশু রাফিনের কান্না যেন কোনোভাবেই থামছে না। গতকাল রাতে ছুরিকাঘাতে নিহত সজল আহমেদের একমাত্র সন্তান রাফিন। আজ সকালে সজলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা জেসমিন খাতুনের কোলে অনবরত কেঁদেই চলেছে শিশু রাফিন। জেসমিন জানান, তিন বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছে। স্বামী সজল পেশায় ছিলেন আলমসাধুচালক। বাবার খুবই ভক্ত রাফিন। গতকাল রাত থেকে বাবাকে না পেয়ে একবার ঘরে ঢুকছে এবং বাড়ির উঠানে রাখা আলমসাধুর কাছে গিয়ে বাবাকে খুঁজছে আর অনবরত কাঁদছে।

চুয়াডাঙ্গায় খুন হওয়া সজলের স্ত্রী জেসমিন। তাঁর কোলে সজলের দেড় বছরের ছেলে রাফিন। আজ বুধবার সকালে আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

জেসমিন বলেন, ‘লোকটা গতকাল দুপুরি বাড়িত্তি বের হওয়ার সুমায় ছেলেডাও বাপের পেচ পেচ (পেছনে পেছনে) রাস্তা পইর্যন্ত যায়। ছেলেকে দেকিয়ে সে আমার বোলে যে রাফিনের ভালো করে দেকে রাইকো। কদিন ধইরে আমার শরীলডা খারাপ। বিকেলে ফোন করে বুলল রাতি বাড়ি আসার সুমায় ওষুদ নিয়ে আসপে। তার আর বাড়ি ফিরা হলো না।’

সজলের বাবা আমজাদ হোসেন জানান, চার সদস্যের পরিবারে সজল ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর অকালমৃত্যুতে গোটা পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। আমজাদ বলেন, ‘সামান্য কারণে আমার ছেলেকে যারা খুন করেচে, আমি তাদের ফাঁসি চাই, জীবনের বদলে জীবন চাই।’

মনকে বুঝ দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না মামুনের বাবা-মা

স্নাতক পাস মামুন অর রশিদ(২৪) চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় একটি এনজিওতে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে আবদুল আজিজ-মমতাজ বেগম দম্পতি দিশাহারা। আজ সকালে সরেজমিন কয়রাডাঙ্গা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলে হারানোর শোকে মুহ্যমান বাবা আবদুল আজিজ। মা মমতাজ বেগমকে ঘিরে থাকা স্বজনেরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নিজেদেরকে বুঝ দেওয়ার ভাষা ভুলে গেছেন মামুনের মা–বাবা।

চুয়াডাঙ্গায় খুন হওয়া মামুন অর রশিদের বাবা-মায়ের আহাজারি। আজ বুধবার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

আবদুল আজিজ বলেন, চাকরির পাশাপাশি কৃষিকাজেও সহযোগিতা করতেন মামুন। এমনকি গতকাল বিকেলেও মাঠ থেকে ঘাস কেটে এনে গরুকে খাইয়েছেন। ছোট ছেলে হওয়ায় তিনি ছিলেন সবার আদরের, নয়নের মণি। চাকরিতে ঢোকার পর তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মেশার তেমন সময় পেতেন না। গতকাল বিকেলে বাড়ি থেকে যাওয়াটাই যে শেষ যাওয়া, তা বুঝতে পারেননি।

মামুন অর রশিদের মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্টে সন্তান মানুষ করিচি। সুনার টুকরো ছেলের কারণে সেই সংসারে অ্যাকন অনেক সুখ। সেই সুখ আমার সুনার কপালে সহ্য হলো না। আমার বুকির ধনকে যারা খুন করেচে, তাদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’

পুলিশের তৎপরতা

সদর উপজেলার ভালাইপুর বাজারে জোড়া খুনের ঘটনায় ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশের তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে ভালাইপুর বাজার এবং আশপাশের এলাকায় পোশাকে ও সাদা পোশাকে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামানসহ কর্মকর্তারা রাতেই সরেজমিন পরিদর্শন ও অভিযানে নেতৃত্ব দেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু তারেক প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দিবাগত রাতে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে মিঠু ও মানিক নামের দুজন হামলায় সরাসরি অংশ নেন। আরেকজনের বিষয়ে তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহাব্বুর রহমান বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় আজ দুপুর পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি। দুপুরে নিহত ব্যক্তিদের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে আজ বেলা আড়াইটার দিকে তাঁদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ফাতেহ আকরাম বলেন, কাগজপত্র প্রস্তুতের কাজ শেষ পর্যায়ে। চিকিৎসা কর্মকর্তা ওয়াহিদ মাহমুদ ময়নাতদন্ত করবেন।