চাল না পেয়ে হতাশ জেলেরা

ভোলায় নিবন্ধিত জেলে ১ লাখ ৬৫ হাজার। এর মধ্যে কার্ডধারী জেলে ১ লাখ ৩৫ হাজার। অথচ চাল বরাদ্দ হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৯ জনের।

ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে জেলেদের মধে্য চাল বিতরণ করেন চেয়ারম্যান সেলিম হাওলাদার
ছবি: প্রথম আলো

প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের ২৫ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা। কিন্তু ভোলায় অনেক দুস্থ জেলে এই চাল পাননি। এমনকি কার্ডধারী কিছু জেলেও চাল পাননি। আবার যাঁরা চাল পেয়েছেন, তাঁদের কম চাল দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনা ঘটেছে ভোলার বিভিন্ন উপজেলায়। জেলার আটটি ইউনিয়নের জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক বিরুদ্ধে কয়েকজন জেলে চাল কম দেওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। গত ২৬ অক্টোবর তাঁরা ওই অভিযোগ দেন।

সৈয়দপুর ইউনিয়নের মো. মোস্তফা, মো. অলিউল্লাহ, মো. মোশাররফ, মো. সাকিবসহ একাধিক কার্ডধারী জেলে ওই লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তাঁরা কার্ডধারী ও অসহায় জেলে হয়েও চাল পাননি। তাঁদের ইউনিয়নে কার্ডধারী জেলের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৯০। চাল বরাদ্দ হয়েছে ৪ হাজার ৬০৩ জনের। ৮৭ জনের চাল কম এলেও, তাঁদের মতো কয়েক শ কার্ডধারী জেলে চাল পাননি। আবার চাল দেওয়া হয়েছে তাঁদের পাঁচ-সাত কেজি করে চাল কম দিয়েছেন চেয়ারম্যানের লোকজন।

জেলেদের চাল কম দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে সৈয়দপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মালেক বলেন, লিখিত অভিযোগ সত্য নয়। তিনি যথাযথভাবে চাল বিতরণ করেছেন।

একই উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের কার্ডধারী জেলে আবদুল মান্নান চাল পাননি। তিনি বলেন, প্রতি মাসে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত তাঁর ছেলে মো. জুনায়েদ (৮) ও মেয়ে তামান্না আক্তারকে (৯) দুই ‌‍ব্যাগ করে রক্ত দিতে হয়। রক্ত ও বাজারের খরচ মিলিয়ে প্রতি মাসে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ আছে। এই টাকা জোগাড় করতে তাঁকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়।

আবদুল মান্নানের মতো একজন জেলেকে বছরে ৩ দফায় ১৪৮ দিন বেকার থাকতে হয়। তাঁদের ৩ দফায় ২৭০ কেজি চাল পাওয়ার কথা। বছরের শেষ দফা ২২ দিনের মা–ইলিশের প্রজনন মৌসুম (১২ অক্টোবর-২ নভেম্বর)। শেষ দফায় ভবানীপুর ইউনিয়নের ২ হাজার ১০৯ জন নিবন্ধিত (কার্ডধারী) জেলের মধ্যে ২ হাজার ৭০ জন জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আবদুল মান্নান জানান, মা-ইলিশ প্রজনন মৌসুম তো দূরের কথা, চলতি বছর তাঁকে এক কেজি চাল দেওয়া হয়নি। যদি দিত, তাহলে চারজনের অভাবের সংসার একটু ভালো চলত।

আবদুল মান্নানের মতো ভবানীপুর ইউনিয়নের কয়েকজন কার্ডধারী জেলে চাল পাননি। যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরাও ২৫ কেজি করে পাননি। ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নুর ইসলাম মাঝি (৫৫) বলেন, তাঁদের ৪ জনকে ৩০ কেজির ৩টি বস্তা দেওয়া হয়েছে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু ৩০ কেজির বস্তায় চাল কম থাকায় ২২ কেজির বেশি কেউ পাননি।

ভবানীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তিনি চাল বিতরণের উদ্বোধন করেছেন। তখন তিনি অতিথি ও তিন হাজার জেলের উপস্থিতিতে বলেছেন, ‘কোনো কার্ডধারী চাল না পেলে সরাসরি চেয়ারম্যানকে এসে বলবেন। প্রয়োজনে নিজের পকেট থেকে চাল কিনে দেবেন, তারপরও জেলেরা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে না এসে কেনো আপনাদের (সাংবাদিক) কাছে যান, বুঝি না।’

দৌলতখান উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২২ হাজার ৭৪০। কার্ডধারী জেলে ২১ হাজার ২৯৩ জন। চাল বরাদ্দ এসেছে ২০ হাজার ৮৯৯ জনের নামে। কিন্তু জেলেরা জানান, কমপক্ষে ছয়-সাত হাজার জেলে চাল পাননি। যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরাও কম পেয়েছেন।

মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার ৭২২ জন জেলের মধ্যে ৩ হাজার ৪৫৪ জন জেলের নামে চাল এসেছে। ওই ইউপির কয়েকজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, ৯ জন ইউপি সদস্যকে চেয়ারম্যান ২ হাজার ১৭০ জন জেলের স্লিপ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ, মৎস্য লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ মিলিয়ে আরও ২৫০টি চালের স্লিপ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৪২০ জন জেলেকে ১৮-২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। বাকি চাল চেয়ারম্যান আত্মসাৎ করেছেন।

চাল আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাজিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন বলেন, চাল বিতরণের সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ মৎস্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনো অনিয়ম করেননি।

তবে ইউপি সদস্যরা জানান, কর্মকর্তারা উদ্বোধন করে চলে আসেন। আর কতজন জেলেকে চাল দেওয়া হয়েছে, সেটি কর্মকর্তারা কী করে বলবেন।

এ বিষয়ে মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, তিনি নিজেই হাজিরহাটের চাল বিতরণের উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু কোনো জেলে তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ করেননি। তারপরও তিনি অভিযোগ পেয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেবেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের ভোলায় নিবন্ধিত জেলে ১ লাখ ৬৫ হাজার। কার্ডধারী জেলে আছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার। তার মধ্যে অনেক কার্ডধারী জেলে মারা গেছেন। কিন্তু চাল বরাদ্দ হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৯ জনের। হয়তো এ কারণে কয়েকজন জেলে বাদ পড়তে পারেন। কিন্তু কার্ডধারী জেলে তেমন বাদ পড়ার কথা নয়। চাল বণ্টনের দায়িত্ব প্রশাসনের। তারপরও তিনি এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।

জেলা প্রশাসক মো. আরিফুজ্জামান সৈয়দপুর ইউনিয়নের জেলেদের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। অন্যান্য উপজেলায় যেখানে অভিযোগ পেয়েছেন, সেসব উপজেলার ইউএনওদেরও ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।