গৃহকর নিয়ে আবার মুখোমুখি চট্টগ্রাম বন্দর ও সিটি করপোরেশন
গৃহকর নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের আবারও বিরোধ দেখা দিয়েছে। সাবেক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সময় বন্দরের গৃহকর ৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ১৬০ কোটি টাকা গৃহকর চায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এই টাকা পরিশোধ করতে সম্প্রতি বন্দরকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। সিটি করপোরেশনের এই দাবিকে ঘিরে গৃহকর নিয়ে বন্দরের সঙ্গে ২৫ বছর আগের পুরোনো বিরোধ আবার সামনে এসেছে।
সিটি করপোরেশনের আশা, বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা নিয়ম অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করে আসছে। এখন নতুন করে গৃহকরের হার নির্ধারণ করেছে সিটি করপোরেশন। এটা নিয়ে বন্দর বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে।
বন্দরকে দেওয়া সিটি করপোরেশনের চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তার ধারণক্ষমতা ৬-১০ টন হলেও ৫০-৬০ টনের বোঝা নিয়ে ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন গাড়ি চলাচল করায় নগরীর অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে নিয়মিত রাস্তা-কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এতে নগরবাসীর চলাচলে যানজটসহ চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের চলাচলের জন্য সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব রাস্তাঘাট সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা জোগান দেওয়া সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর চিঠি দেন। এতে চলতি বছরের বকেয়া ১১৫ কোটি টাকা পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময় গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। ওই সময় স্থাপনার ভাড়ার ভিত্তিতে গৃহকর নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। তখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপনার জন্য গৃহকর নির্ধারণ করা হয় ১৬০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আগে স্থাপনার আয়তনের ভিত্তিতে গৃহকর আদায় করত সিটি করপোরেশন। ফলে বন্দরের গৃহকর ছিল সাড়ে ৩৫ কোটি টাকা।
বাড়তি গৃহকর নির্ধারণ করার অভিযোগে তা বাতিলের জন্য আন্দোলনে নামেন সাবেক মেয়র ও বিভিন্ন সংগঠন। তাঁদের আন্দোলনের মুখে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশনের গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম স্থগিত করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তৎকালীন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় মন্ত্রণালয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের একটি সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বন্দর কর্তৃপক্ষের গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে গৃহকর পুনর্নির্ধারণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে আবেদন করা হয়। পরে অপসারিত মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সময় ৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ১৪ জুলাই দুই পক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এ গৃহকর নির্ধারণ করা হয়। বৈঠকে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিয়ম অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের গৃহকর পরিশোধ করে আসছেন। এখন সিটি করপোরেশন নতুন করে গৃহকরের হার নির্ধারণ করে তা পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছে। তা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিবেচনাধীন রয়েছে। বন্দর বোর্ড সভায় সিটি করপোরেশনের দাবির বিষয় উপস্থাপন করা হবে। এ ব্যাপারে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গৃহকর নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের এমন বিরোধ এবারই প্রথম নয়। ৩০ বছর আগেও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা গৃহকর দাবি করা হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করত। তবে ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে এ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। সিটি করপোরেশনের দাবি অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ না করায় বকেয়া দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এ পাওনা আদায়ে অনড় অবস্থান নিয়েছিলে সিটি করপোরেশন। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপে তা সমাধান হয়। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে ১১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করে।
গৃহকর নিয়ে পুরোনো বিরোধ মাথাচাড়া দেওয়ার আভাস পাওয়া গেছে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে দেওয়া সিটি করপোরেশনের চিঠিতে। এতে বকেয়া পরিশোধের তাগাদা দেওয়া হয়। সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপনার জন্য ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ টাকা গৃহকর নির্ধারণ করা হয়। যা ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে কার্যকর হয়। এ অর্থ পরিশোধের জন্য বারবার চিঠি দেওয়া হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ তা অপারগতা প্রকাশ করছে। ১৬০ কোটি টাকার পরিবর্তে ৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করছে।
বন্দরকে দেওয়া সিটি করপোরেশনের চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে। ফলে এ অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল রাখতে সড়ক-মহাসড়কগুলো সচল রাখা এবং এর সার্বক্ষণিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তার ধারণক্ষমতা ৬-১০ টন হলেও ৫০-৬০ টনের বোঝা নিয়ে ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন গাড়ি চলাচল করায় নগরীর অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে। ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে নিয়মিত রাস্তা-কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এতে নগরবাসীর চলাচলে যানজটসহ চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের চলাচলের জন্য সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব রাস্তাঘাট সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা জোগান দেওয়া সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সিটি করপোরেশনকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করবে বলে আশাবাদী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের নির্ধারণ করা ১৬০ কোটি টাকা গৃহকর নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের আবেদনের বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ ৪৫ কোটি টাকা করে গৃহকর পরিশোধ করছে। তাই বকেয়া গৃহকর পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। বন্দর যদি সিটি করপোরেশনের দাবি অনুযায়ী গৃহকর পরিশোধ করে, তাহলে সংস্থার আর্থিক চাপ অনেকটাই কমবে।