ধামরাইয়ের বেতলাই বিল খননে মানা হচ্ছে না কোনো শর্ত 

  • ঠিকাদার আবদুর রশিদ ধামরাই উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

  • প্রয়োজনের বেশি মাটি খনন করে বিলটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও ঢাকার ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের বেতলাই বিলে খননকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার। মানা হচ্ছে না বিলের মাটি কাটার শর্ত। গত রোববার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় মৎস্যজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার ধামরাইয়ের কুল্লা ইউনিয়নের বেতলাই বিলে খনন ও সংস্কার চলছে। কিন্তু বিলের মাটি খনন ও ক্রয়ের কাজ পাওয়া ঠিকাদার বিল প্রশাসনের কোনো শর্ত মানছেন না। প্রয়োজনের বেশি মাটি খনন করে বিলকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

খননকাজের শর্তে ছিল, কার্যাদেশ পাওয়ার চার মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে খনন করা মাটি অপসারণ; ১৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট পর্যন্ত মাটি খনন; বিলের পাড় থেকে ৪৫ ডিগ্রি ঢাল (স্লোপ) রেখে বর্তমান (কার্যাদেশের সময়) তল থেকে গড়ে চার ফুটের বেশি গভীর করে খনন করা যাবে না।

৪৮ লাখ টাকায় বিল খননের কাজটি নেওয়া হলেও ইতিমধ্যে আড়াই কোটি টাকার ওপরে মাটি বিক্রি করা হয়েছে।

এসব শর্তের কিছুই মানা হচ্ছে না। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও চলছে খনন ও মাটি অপসারণের কাজ। এ ক্ষেত্রে সময়ও বাড়িয়ে নেওয়া হয়নি। দুই থেকে চারটি ড্রেজারে প্রতিনিয়ত তোলা হচ্ছে বিলের মাটি। খননের কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যানুসারে, ৪৮ লাখ টাকায় বিল খননের কাজটি নেওয়া হলেও ইতিমধ্যে আড়াই কোটি টাকার ওপরে মাটি বিক্রি করা হয়েছে।

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বন্যা, শ্রমিকসংকটসহ কিছু জটিলতার কারণে ঠিকাদার যথাসময়ে খনন শেষ করতে পারেননি। শিগগিরই তিনি খননকাজটি সমাপ্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। খননের শর্তভঙ্গসহ অন্য বিষয়গুলো যাচাই করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে ঠিকাদার মো. আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কার্যাদেশ পাওয়ার পর কয়েক মাস এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হয়। তবে পরে বন্যার পানি চলে আসায় উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ড্রেজার দিয়ে পুনরায় খনন শুরু হয়। বন্যার পানির কারণে যথাসময়ে খনন শেষ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা প্রশাসনকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে খননকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজন জানান, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বেতলাই বিলে মাছ চাষের জন্য ইজারা নিয়েছে ধামরাইয়ের কায়েতপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। বিলের বেশ কিছু জায়গা ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন জানান সমিতির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত বছরের মার্চে উপজেলা প্রশাসন বিলটি খনন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের সার্ভেয়ার ২৬ দশমিক ৩২ একরের বিলটি খনন ও সংস্কার করা প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, খননের ফলে বিল থেকে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট মাটি উত্তোলন করা সম্ভব। স্থানীয় বাজারদর হিসাবে ওই মাটির সম্ভাব্য মূল্য উল্লেখ করা হয় প্রায় ৪১ লাখ টাকা। দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ দরদাতা (৪৮ লাখ টাকা) হিসেবে মো. আবদুর রশিদকে কার্যাদেশ দেন জেলা প্রশাসক। আবদুর রশিদ ধামরাই উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, গত বছরের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে মাটি কাটার যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে বিলের মাটি কাটা শুরু করা হয়। দু–এক মাসের মধ্যে বিলে বন্যার পানি চলে এলে ড্রেজার দিয়ে মাটি খনন শুরু করা হয়। ড্রেজার দিয়ে বেশি গভীর করে মাটি খনন করায় হুমকির মুখে রয়েছে বিলসংলগ্ন কৃষিজমি। এসব জমি বিলে ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।

স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি শুকিয়ে গেলে তখন জমির মাটি বিলে ভেঙে পড়বে।’

ড্রেজার দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গভীর করে খনন করায় বিলে মাছ চাষে অসুবিধা হবে বলে জানালেন কায়েতপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি শ্রী খগেশ চন্দ্র রাজবংশী।

গত রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, বিল থেকে চারটি ড্রেজারে মাটি তোলা হচ্ছে। বিলের মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছিল পার্শ্ববর্তী একটি কৃষিজমি। এই মাটি বিক্রির সঙ্গে জড়িত শিশির নামের এক ব্যক্তি জানান, জায়গাটি ভরাট করতে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ ঘনফুট মাটি প্রয়োজন হবে। দূরত্বভেদে প্রতি ঘনফুট মাটির দাম ৯ থেকে ১১ টাকা।

বেতলাই বিলের মাটি বিক্রির সঙ্গে এবং ড্রেজার–সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানান, প্রতিদিন সাধারণত ৪ ইঞ্চি পাইপের একটি ড্রেজার দিয়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার ঘনফুট মাটি উত্তোলন করা সম্ভব। দুটি ড্রেজার ধরা হলেও ছয় মাসে ২৮ লাখ ৮০ হাজার ঘনফুট মাটি খনন করা হয়েছে। প্রতি ঘনফুট ৯ টাকা হিসাবে এসব মাটির মূল্য প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার টাকা।