পানিতে ভিজে উঠতে হয় তীরে

ভাটার সময় কোমরসমান পানিতে নেমে কখনো কখনো এক কিলোমিটারের মতো নদীতে হেঁটে উঠতে হয় সড়কে।

ভাটার সময় ট্রলারের মাঝি যাত্রীদের মেঘনা নদীর মধ্যে নামিয়ে দিচ্ছেন। যাত্রীরা পানি ভেঙে যাচ্ছেন তীরের দিকে। ৪ ফেব্রুয়ারি ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর রাস্তারমাথা ঘাটেছবি: প্রথম আলো

ভোলার ধনিয়া তুলাতুলি থেকে মদনপুর রাস্তারমাথা আন্ত–উপজেলা নৌপথে যাতায়াত এখন এক ভোগান্তির নাম। ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে এই পথে মেঘনা পাড়ি দিতে প্রতিদিন যাত্রীদের ভিজতে হয় কাদাপানিতে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কংক্রিটের শেওলা পড়া ব্লকে পিছলে পড়ে আহত হওয়ার বিড়ম্বনা। বছরের পর বছর ঘাট ইজারা দিয়ে সরকার মোটা টাকা আয় করলেও যাত্রী পারাপারে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ডুবোচরের কারণে ভোগান্তি আরও চরমে উঠেছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এ নৌপথটির এক পাড়ে ভোলা সদরের ধনিয়া তুলাতুলি ঘাট। অপর পাড়ে দৌলতখানের মদনপুর রাস্তারমাথা ঘাট। দুই ঘাটেই যাত্রী ওঠানামার জন্য পাকাঘাট বা জেটি নেই। ধনিয়া তুলাতুলি ঘাটে রয়েছে নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য নির্মিত ব্লকবাঁধ। সেখানে ট্রলার থেকে যাত্রীদের যেখানে নামিয়ে দেওয়া হয়, সেখান থেকে তীর অনেক খাড়া। ব্লকগুলো শেওলা পড়া। ফলে এসব ব্লক পেরিয়ে খাড়া তীরে উঠতে প্রায়ই যাত্রীরা পিছলে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। যাত্রীরা এই ভোগান্তি থেকে বাঁচার জন্য এখানে পাকা সিঁড়ি বা জেটির দাবি জানিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরে।

মদনপুর রাস্তারমাথা ঘাটে যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বেশি। মদনপুর ঘাটের কিনারে ভাটার সময় যাত্রীদের নদীর পানির মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হয়। কোমর সমান পানিতে নেমে কখনো কখনো এক কিলোমিটারের মতো নদীতে হেঁটে উঠতে হয় সড়কে। জোয়ারের সময়ও ভোগান্তি কম নয়। তখন কিছুটা এগিয়ে নামতে পারলেও যাত্রীদের কাদা মাখামাখি করে উঠতে হয় সড়কে।

সরেজমিন

৪ ফেব্রুয়ারি ট্রলারে করে এই নৌপথ পাড়ি দেওয়ার সময় যাত্রী ও মাঝিরা জানান, দৌলতখানের মদনপুর ইউনিয়নে যেতে সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ তুলাতুলি-মদনপুর রাস্তারমাথা নৌপথ। অন্য নৌপথগুলো আরও দুর্গম। মেঘনার মাধ্যে অবস্থিত দুর্গম মদনপুর ইউনিয়নে যেতে সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি খেয়াঘাটে যেতে হয়। তুলাতুলি ঘাট এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ব্লকবাঁধ নির্মাণ করে, যা প্রায় ক্ষয়ে যাওয়ার অবস্থায় আছে। সকাল সাড়ে আটটায় দিনের প্রথম ট্রলারে পার হওয়ার সময় ভাটা চলছিল। এ সময় মেঘনার পানি নিচে নেমে যাওয়ার কারণে তীর অনেকটা খাড়া দেখা যায়।

দেখা যায়, তীরের ব্লকগুলোর এবড়োখেবড়ো, তার ওপর শেওলা পড়া। পিছলে পড়ার ভয়ে সাবধানে পা ফেলে ট্রলারে উঠতে হলো। যাত্রীরা জানান, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই যাত্রীদের কাদাপানি ভেঙে নৌকায় ওঠানামা করতে হচ্ছে।

ট্রলারের মধ্যে পরিচ্ছন্ন কোনো বসার স্থান নেই। মাছের ঝুড়ি আর মালামালে ভর্তি। বাধ্য হয়ে নৌকার কিনারে বসতে হলো। নারী, শিশু ও পুরুষ যাত্রীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় নিয়ে ময়লার মধ্যেই কষ্ট করে বসে পড়েন। বসার জায়গা না থাকলেও দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক, কারণ উত্তাল মেঘনায় ট্রলার ছুটে চলার সময় দাঁড়িয়ে থাকলে উপুড় হয়ে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবেই ভিড় গাদাগাদির মধ্যে মদনপুর রাস্তারমাথা ঘাটে পৌঁছানোর আগেই ট্রলার থেমে গেল নদীর মধ্যে।

নৌকার মাঝি আবুল কালাম সিকদার জানালেন, ‘আর সামনে যাইব না। চরে আটকাই গেছে। এহোন পানির মইধ্যে নাইমমা আইড্ডা (হেঁটে) যাইতো অইব।’

ট্রলারের মাঝি ঘাট থেকে প্রায় ৮০০-৯০০ মিটার আগে মেঘনা নদীর মধ্যে যাত্রীদের নামিয়ে দিলেন। স্থানীয় যাত্রীরা লুঙ্গি গুটিয়ে তাঁদের মালামাল মাথায় নিয়ে পানির মধ্যে লাফিয়ে পড়ে হেঁটে যান। নারী, শিশু, প্যান্ট-শার্ট পরা চাকরিজীবীরা অনেক কষ্টে ঘাটের দিকে এগোন। কারও কাপড়চোপড় ভিজতে বাকি থাকে না।

অন্যান্য যাত্রীর মতো প্যান্ট-পায়জামা ভিজিয়ে কাদাপানি ভেঙে রাস্তারমাথা ঘাটে এসে এক বাড়ির নলকূপে পা ধুয়ে নিই। কিন্তু ফেরার সময় দেখি, এবার যাত্রীদের সঙ্গে ট্রলারে গরু, ছাগল, মহিষও উঠেছে। উঠেছে জেলেদের মাছ, গবাদিপশুর ঘাস, খেতের তরকারি, নানা রকম ফসল। যাত্রীর সংখ্যাও পঞ্চাশের অধিক।

ট্রলারের যাত্রী ভোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শারমিন জাহান বলেন, ‘মদনপুরের একটি বিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলাম। নদীর মধ্যে নামার পরে জামাকাপড়ে কাদাপানি মেখে সব ভিজে গেছে। এখন যেতে লজ্জা লাগছে।’ শারমিন জাহান আরও বলেন, ১০ মিনিট পথের ভাড়া ৪০ টাকা নিচ্ছে। কিন্তু মাঝিরা ট্রলারের যাত্রীর চেয়ে গরু-ছাগলের খাতির বেশি করছে। কারণ, ওদের ভাড়া বেশি।

কর্তৃপক্ষ দিল আশ্বাস

তুলাতুলি-রাস্তার মাথা নৌপথের সাবেক ইজারাদার মো. আসলাম গোলদার বলেন, এ নৌপথে ট্রলার থেকে ঘাটে বা রাস্তায় ওঠানামার কোনো সুবিধাজনক ব্যবস্থা নেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে ডুবোচর। গত দুই-তিন বছর ধরে ভাটার সময় যাত্রীদের নদীর মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা ওঠানামা করতে গিয়ে কাদাপানির সঙ্গে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার চরের রাস্তা-ঘাটের কোনো উন্নয়ন করেননি।

মদনপুর ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম নাছির উদ্দিন বলেন, একে তো দুর্গম ইউনিয়ন মদনপুর। সরকারি বরাদ্দ নেই বললেই চলে। তাই এত দুরবস্থা। তুলাতুলি-মদনপুর নৌপথ ইজারা হয় জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে। গত বছর জেলা প্রশাসক চরবাসীকে লিখিত আবেদন করতে বলেন। লিখিত আবেদন করলেও কোনো দপ্তর থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক বিবেক সরকার ইউনিয়নবাসীকে সমস্যা সমাধানে লিখিত আবেদন করতে বলেন। তিনি সবার সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন।

ভোলা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মমিনও বলেন, ‘ইউনিয়নবাসীকে আবেদন করতে বলুন, দেখি কী করতে পারি।’