রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার ছাড়া সংস্কারপ্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি সফলতা বয়ে আনবে না

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রাজনীতি, সমাজ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী পর্বে অতিথিরা। আজ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটরিয়ামেছবি: আনিস মাহমুদ

জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তীকালে অনেক সংস্কার কার্যক্রম চলছে। এসব সংস্কারপ্রক্রিয়া সফলতার মুখ দেখবে কি না, সন্দেহ আছে। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিচর্চা সুখকর নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত ইতিহাস আমাদের মধ্যে ভিন্ন ধারণা তৈরি করেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার ছাড়া বর্তমান সংস্কারপ্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি সফলতা বয়ে আনবে না।

আজ শনিবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) মিনি অডিটরিয়ামে পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের ‘রাজনীতি, সমাজ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপনী পর্বে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে শিক্ষার পরিবেশ ভালো থাকে। সম্মেলনে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা হওয়ায় সমকালীন রাজনীতিতে এই ইস্যুটাও গুরুত্ব পাবে।’

বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত সমাপনী পর্ব চলে। এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন শাবিপ্রবির সহ-উপাচার্য মো. সাজেদুল করিম। সম্মেলন আয়োজক কমিটির সহ সদস্যসচিব মো. সাহাবুল হকের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মোহাম্মদ জহিরুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন ও শাবিপ্রবির কোষাধ্যক্ষ মো. ইসমাইল হোসেন।

মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, ‘কোনো উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি রাজনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপূরক নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য কামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বায়নের হয়ে উঠতে হবে। এখানকার শিক্ষার্থীরা অক্সফোর্ডে গিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু অক্সফোর্ড শুধুই একা নয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী গবেষকেরা গিয়ে এর বিশেষত্ব বাড়িয়েছেন। তেমনি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এমন সম্মেলন করতে হবে। রাজনীতিতে শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা পথ দেখাবে। অবদান রাখবে নীতিনির্ধারণে।’

আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী পর্বে উপস্থিতিদের একাংশ। আজ শনিবার শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটরিয়ামে
ছবি: আনিস মাহমুদ

সম্মেলনের সমাপনী পর্বে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন শাবিপ্রবির পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আশরাফুর রহমান, সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক দিলারা রহমান, সদস্যসচিব জায়েদা শারমিন, সহ–আহ্বায়ক মো. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক আল আমিন, চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোয়াং হুই, ইতালির স্কোলা নরমালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোমানে কাওকি প্রমুখ।

সমাপনী পর্বে সভাপতির বক্তব্যে শাবিপ্রবির সহ–উপাচার্য মো. সাজেদুল করিম বলেন, ‘আমাদের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই খারাপ। কী হয় কী না-হয়, তা আমরা জানতে পারি না। জানার আগ্রহ কিংবা সমস্যার কথা বলতে গিয়েই জায়গা হতো আয়নাঘরে। এগুলো আমাদের সরকারব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছিল। কারণ, উন্নয়ন আর গণতন্ত্রকে চালাতে গিয়ে বিপর্যয় বিপত্তি ঘটানো হয়েছে।’

এর আগে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আজ সকাল নয়টার দিকে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের বিভিন্ন কক্ষে একাধিক সেশন অনুষ্ঠিত হয়। ‘গ্লোবাল সাউথ: চায়না অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ শীর্ষক সেশনের আলোচক ও শাবিপ্রবির সহযোগী অধ্যাপক ফাখরুস সালাম বলেন, ‘ভারত ও চীন উভয়ই গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ দেশ, যাদের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সহযোগিতা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলে। গ্লোবাল সাউথে কূটনৈতিক সম্পর্কগুলো দ্বিপক্ষীয় হওয়া উচিত। এখানে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ও প্রভাব তৈরি করা অশনিসংকেত।’

সম্মেলনের আরেকটি প্যারালাল সেশনে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সক্রিয়তায় জেন-জি রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজম গড়ে তোলেন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শাবিপ্রবির পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান মাসরুর। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে জেন-জির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে জুলাই মাসের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের তরুণদের প্রতি রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আস্থাও বেড়েছে। তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে এবং নতুন চিন্তাভাবনা ও পরিবর্তনের রাজনৈতিক আলোচনা তুলে ধরছে। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও সচেতনতা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে।’

‘গভর্ন্যান্স, পরিবেশ ও রাজনীতি’ শীর্ষক একটি প্যারালাল সেশনের সভাপতি শাবিপ্রবির অধ্যাপক মো. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘এখানে বিশেষ করে তরুণ শিক্ষার্থীরা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। কেউ কেউ প্রথমবার প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। নানা সমস্যা ও ঘাটতি থাকলেও তাঁরা প্রবন্ধ উপস্থাপন করাতে তরুণদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। ভবিষ্যতে তারা দেশ ও সমাজের জন্য ভূমিকা রাখবে।’

সম্মেলনে ১২০ জন মূল আলোচক ও বিচারক ছিলেন। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, বেলজিয়ামসহ ৮টি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শ গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অংশ নেন
ছবি: আনিস মাহমুদ

আয়োজকেরা জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে ২টি প্ল্যানারি সেশন ও একটি অনলাইনসহ ১৫টি প্যারালাল সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১১০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। রাজনীতি, সুশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাংলাদেশের চলমান সংস্কার, গণতন্ত্র, মিডিয়া, নাগরিক, লিঙ্গ, শিক্ষা, অভিবাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি, রাজনৈতিক উন্নয়ন, ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও আন্তর্দেশীয় সম্পর্ক, পরিবেশ, জলবায়ুসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ১১৬ জন গবেষক ও চিন্তক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন।

একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সম্মেলনে ১২০ জন মূল আলোচক ও বিচারক ছিলেন। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, বেলজিয়ামসহ ৮টি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচ শ গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অংশ নেন।

গতকাল সকালে শাবিপ্রবির কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম। সম্মেলনে মূল বক্তার বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো রওনক জাহান।