ভুট্টা চাষ কমিয়ে গমে ঝুঁকছেন চাষিরা

চট্টগ্রামে গম চাষ তেমন প্রচলিত নয়। অনুকূল নয় আবহাওয়াও। তবু এবারের শীত মৌসুমে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে—ভুট্টার জমি কমিয়ে কৃষকেরা গম চাষে ঝুঁকছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও গম উৎপাদন বাড়ানোর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।

অধিদপ্তরের প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি রবি মৌসুমে জেলায় ৯৫ হেক্টর জমিতে ২৮৫ টন গম উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, বাঁশখালী, আনোয়ারাসহ কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে এবার গমের আবাদ বাড়ানো হচ্ছে। এসব এলাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় অন্য শস্যে ফলন কমে, তবে গমের কিছু জাত স্বাভাবিকভাবেই লবণসহিষ্ণু।

চট্টগ্রামে মূলত তিন জাতের গম চাষ হচ্ছে—বারি-৩৩, বিডব্লিউএমআরআই-১ ও বিডব্লিউএমআরআই-২। বারি-৩৩ উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আর বাকি দুটি জাত এসেছে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে। নভেম্বরের মাঝামাঝি বীজ রোপণ করা হয়। তিনটিই উচ্চ ফলনশীল জাত, প্রতি হেক্টরে ৪-৫ টন পর্যন্ত ফলন হয়।

চট্টগ্রাম জেলায় আবাদযোগ্য জমি প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ। তিন মৌসুমে-রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২ তাঁরা ফসল উৎপাদন করেন। রবি মৌসুমে (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) হয় বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, গম, তেলবীজ ও ডাল।

গমের ব্যবহারও বহুমুখী—নুডলস, বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুর থেকে শুরু করে হিমায়িত খাদ্যপণ্য; সবকিছুই তৈরি হয় গম দিয়ে। তবে দেশের উৎপাদন এখনো চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে মোট চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ গম আমদানি করতে হয়। গত অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ৫৯ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ১৬৩ কোটি ডলার (শুল্কায়ন মূল্য ২২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা)।

আগ্রহ বাড়ছে

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, যশোর ও কুষ্টিয়ায় সবচেয়ে বেশি গম উৎপাদিত হয়। তার তুলনায় চট্টগ্রাম এখনো পিছিয়ে, তবে ধীরে ধীরে চাষ বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৩৬ হেক্টর জমিতে ৯৪ টন গম উৎপাদিত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ হেক্টর জমিতে ২৫৯ টন। অর্থাৎ পাঁচ বছরে আবাদ বেড়েছে আড়াই গুণ এবং উৎপাদন প্রায় তিন গুণ।

অন্যদিকে একই সময়ে ভুট্টার আবাদ তুলনামূলক স্থিতিশীল ছিল। ২০২০-২১ সালে ৩৬৬ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৯২৮ টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়, আর ২০২৪-২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০২ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৯৯৬ টন। অর্থাৎ পাঁচ বছরে আবাদ বেড়েছে ১ দশমিক ১ গুণ, উৎপাদন ১ দশমিক ৪ গুণ। তবে চলতি মৌসুমে ভুট্টার আবাদ বা উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে না; কিছু এলাকায় কমানোও হচ্ছে।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রামের আবহাওয়া গম চাষের জন্য পুরোপুরি অনুকূল নয়। শীত আসে দেরিতে, শেষ হয় তাড়াতাড়ি। তবু ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এবার ভুট্টা কমিয়ে গমের চাষ বাড়ানো হবে। কৃষকদের বীজ ও সার প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের আবহাওয়া গম চাষের জন্য পুরোপুরি অনুকূল নয়। শীত আসে দেরিতে, শেষ হয় তাড়াতাড়ি। তবু ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এবার ভুট্টা কমিয়ে গমের চাষ বাড়ানো হবে। কৃষকদের বীজ ও সার প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে
মো. ওমর ফারুক, অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (চট্টগ্রাম)

গমে মুনাফা পাচ্ছেন কৃষকেরা

ফটিকছড়ি উপজেলায় গত বছর ২৫ হেক্টর জমিতে গমের চাষ হয়েছিল। এবার তা বেড়ে হচ্ছে ৪০ হেক্টর। দাঁতমারা ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর ৪০ শতাংশ জমিতে গম চাষে প্রায় ৬ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এবার আরও জমি নিচ্ছি।’

ফটিকছড়ি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক জানান, শীতকালীন সবজির পাশাপাশি গমের উৎপাদনও বাড়াতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, বীজ ও সার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম খুরুশিয়া মুন্সিরবাম এলাকার কৃষক মো. আনোয়ারুল ইসলামও এবার গম চাষে আরও জমি বাড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘গত বছর ৩০ শতক জমিতে ৬ মণ গম পেয়েছিলাম। লাভ হওয়ায় এবার ৬০ শতক জমিতে চাষ করব।’

চট্টগ্রাম জেলায় আবাদযোগ্য জমি প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর। কৃষক পরিবারের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ। তিন মৌসুমে—রবি, খরিফ-১ ও খরিফ-২ তাঁরা ফসল উৎপাদন করেন। রবি মৌসুমে (১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ) হয় বোরো ধান, শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, গম, তেলবীজ ও ডাল।

বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পূর্ব বড়ঘোনা গ্রামের মাহবুব আলম বলেন, ‘গত বছর গম চাষে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। এবার আরও বেশি জমিতে চাষ করব। ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছি।’ একই ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা সাইবুর রহমান এবারই প্রথম গমের চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সাইবুর জানান, তাঁর পরিচিত অনেকেই গম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আগে কখনো এ শস্য চাষ না করলেও এবার তিনি গম চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।