দারিদ্র্য তাদের স্বপ্নপূরণের বাধা নয়

দারিদ্র্যকে জয় করে সাফল্যের দেখা পাওয়া শিক্ষার্থীদের কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ সরকারের বড় কর্মকর্তা হতে চায়।

অভাব–অনটন, অপ্রতুল সুযোগ–সুবিধা আর নানা প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করেও এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের ঝলক দেখিয়েছে তারা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ মায়ের সেলাই মেশিনের টাকায়, কেউ–বা বাবার ভ্যান চালানোর আয়ে বা ছোট ব্যবসার ওপর ভর করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। পরিবারের সীমাহীন কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা জিপিএ–৫ অর্জন করেছে।

বরিশালের মেহনাজ তাবাসসুম, নড়াইলের অর্পিতা বিশ্বাস, সিরাজগঞ্জের নুসরাত জাহান ও সুনামগঞ্জের ইতি রানী সরকারের সামনে পথচলায় প্রশ্ন একটাই—দারিদ্র্যের দেয়াল কি তাদের স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?

মায়ের সেলাই মেশিনের আয়ে পড়াশোনা

অভাব–অনটনের সঙ্গে লড়াই করে এবারের এসএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছে বরিশালের মেহনাজ তাবাসসুম। কিন্তু এই সাফল্য আনন্দের পাশাপাশি এক অমোঘ প্রশ্নও নিয়ে এসেছে—বরিশাল নগরের ফকিরবাড়ি এলাকার মেয়েটির স্বপ্ন কি দারিদ্র্যের দেয়ালে আটকে যাবে?

বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া মেহনাজ ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু পরিবারের অনটনের কারণে পথচলা সব সময়ই ছিল কষ্টকর। একসময় চাকরি চলে যাওয়ায় ফটোকপি ও কম্পোজের দোকান খুলেছিলেন মেহনাজের বাবা মাসুদ পারভেজ। করোনা মহামারিতে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন মেহনাজের মা সেলাই মেশিন নিয়ে একাই লড়াই শুরু করেন।

মাসুদ পারভেজ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে থেকে একটি সিমেন্ট কারখানায় অল্প বেতনে চাকরি করেন। সংসারের ভার মূলত টানছেন মা ফাতেমা রহমান। বরিশাল শহরে ভাড়া বাসায় বসে তিনি সেলাইয়ের কাজ করে তিন মেয়ের পড়াশোনাসহ অন্য খরচ মেটাচ্ছেন।

ফাতেমা বলেন, ‘টানাপোড়েনের কারণে মেয়েটা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়েছে। একটু ভালো খাবারও দিতে পারিনি। কিন্তু এত কষ্ট বৃথা যাবে, যদি ওর পড়া চালাতে না পারি।’

চোখে জ্বলজ্বলে স্বপ্ন নিয়ে মেহনাজ বলছে, সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায় এবং ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাতে চায়। তবে সেই দীর্ঘ পথ কীভাবে পাড়ি দেবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তাকে প্রতিদিন তাড়া করছে।

মেধাবী মেয়েটার পড়াশোনা কি বন্ধই হয়ে যায়?

পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল অর্পিতা বিশ্বাসের। স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার, কিন্তু অভাবের বাস্তবতা তাকে স্বপ্ন বদলাতে বাধ্য করেছে। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিজ্ঞান বিভাগের পরিবর্তে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের বাসিন্দা অর্পিতা। তার বাবা অসীম কুমার বিশ্বাস একজন কৃষিশ্রমিক। অন্যের জমিতে হালচাষ, নিড়ানি দেওয়া, ধান কাটা—যা কাজ মেলে, তা–ই করেন। এ আয় দিয়েই তিন মেয়ে, স্ত্রীসহ পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হয় তাঁকে। এমন এক বাস্তবতায় মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।

কাশিপুর এ সি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ অর্জন করেছে সে। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের এই স্কুলে প্রায়ই হেঁটে যাতায়াত করতে হয়েছে তাকে।

অর্পিতার বাবা অসীম বিশ্বাস বলেন, মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই খুব মনোযোগী। কখনো পড়তে বলতে হয়নি। সংসারে অভাব থাকায় যতটা দরকার, ততটা দিতে পারেননি। প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে কষ্ট করে চলত।

জীবনের প্রতিটি ধাপে সংগ্রাম করেছে অর্পিতা। কখনো বই-খাতা কেনার টাকাই জোটেনি, কখনো ছিল না স্কুলে যাতায়াতের ভাড়া। অর্পিতা বলে, ‘আমার এখন একটাই স্বপ্ন—পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিসিএস ক্যাডার হওয়া। দেশসেবা করতে চাই। মা–বাবা, শিক্ষকসহ যাঁরা আমার জন্য কষ্ট করেছেন, তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই।’

অর্পিতার মা সুমিতা বিশ্বাস বলেন, ‘আমাগে তিনটা মেয়ে। অর্পিতা সবার বড়। মাইজে মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। পরিবারের একজন মাত্র আয় করে। তিনিও শারীরিকভাবে অসুস্থ। এহন অর্পিতার পড়াশোনা কীভাবে চলবে, সেই চিন্তায় দিন যায় আমাগে। এত মেধাবী মেয়েটার টাকার অভাবে পড়াশোনা কি বন্ধই হয়ে যায়?’

মেয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভ্যানচালক বাবা

অভাব–অনটনের ভেতর দিয়েই লেখাপড়ার স্বপ্ন বুনছে মোছা. নুসরাত জাহান মুক্তা। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানঘরা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। এখন কলেজে ভর্তি ও পড়ালেখার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে মুক্তার পরিবার।

রায়গঞ্জ উপজেলার শৌলি সাবলা গ্রামের অটোভ্যানচালক শফিকুল ইসলাম ও গৃহিণী মরিয়ম খাতুনের তিন সন্তানের মধ্যে মুক্তা ছোট। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা। ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসারই টানাটানি চলে। এর সঙ্গে তিন ভাইবোনের পড়ার খরচ জোগানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

মা মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় ভালো। কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছু দিতে পারি না। ছোট মেয়েটার পড়ার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি।’ বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অটোভ্যান চালিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। তার মধ্যে তিনজনের পড়াশোনার খরচ জোগানো বড় কষ্টের।’

মুক্তা জানায়, পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায়ও জিপিএ–৫ পেয়েছিল। এবারের এসএসসিতে ভালো ফলাফলে পরিবার ও গ্রামজুড়ে খুশির হাওয়া বয়ে গেলেও সামনে পথচলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সে বলে, ‘পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু খরচ কীভাবে জোগাড় হবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছি।’

তবু পড়তে চায় ইতি রানী

অভাবের সংসারে থেকেও পড়াশোনায় অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেখিয়েছে সুনামগঞ্জের ইতি রানী সরকার। এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে একমাত্র জিপিএ–৫ পেয়েছে সে।

ইতি রানীর বাড়ি মধ্যনগর ইউনিয়নের গলইখালী গ্রামে। বাবা দীপক সরকার ছোট আকারে ডেকোরেটরের ব্যবসা করেন। কাজ সারা বছর মেলে না, তাই সংসার চালানোই কষ্টকর। মা নিশা রানী সরকার গৃহিণী। ছয় সদস্যের এই পরিবারে ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই। সংসার চালাতে গিয়ে ইতিমধ্যে তিন লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় চেপেছে।

দীপক সরকার বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে গিয়ে ঋণে ডুবে গেছি। দুই বেলা ঠিকমতো খেতে পারি না। এখন ছোট মেয়েটাকে কীভাবে কলেজে পড়াব, সেই দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারি না।’

মা নিশা রানী সরকার বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনের সাহায্যে কোনো রকমে সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে আসছি। সামনে কী হবে জানি না।’ ইতি রানী জানায়, তার স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। সে বলে, ‘আমাদের সংসারে অভাব অনেক। তার পরও আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই।’

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বিজন কুমার তালুকদার বলেন, ইতি রানী অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। শিক্ষকেরা তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সে অনেক দূর যেতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল, প্রতিনিধি, নড়াইল, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ]