চট্টগ্রাম নগর
এক টেম্পোস্ট্যান্ডে বছরে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
একসময় আওয়ামী লীগের নাম দিয়ে চাঁদা আদায় করা হলেও এখন আদায় হচ্ছে বিএনপির নাম ব্যবহার করে।
চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা শাহ আমানত সেতু মোড়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের জেলা-উপজেলাগুলো থেকে নগরে প্রবেশ করতে হয় এই মোড় হয়েই। এই মোড় থেকে একটি সড়ক মেরিনার্স রোড ও ফিরিঙ্গীবাজার হয়ে নগরের কোতোয়ালি এলাকার দিকে চলে গেছে। এই রুটে প্রতিদিন অন্তত ২০০টি অটোটেম্পো চলাচল করে। এসব টেম্পো থেকে আদায় করা হয় মাসে লাখ টাকার চাঁদা।
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরের শাহ আমানত সেতু মোড় থেকে আলকরণ পর্যন্ত রুটটি ১৭ নম্বর রুট হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন এই পুরো রুটের টেম্পোগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন চালকদের থেকে দৈনিক লাইন চার্জের নামে টাকা তোলা হয়। একসময় আওয়ামী লীগের নাম দিয়ে চাঁদা আদায় করা হলেও এখন আদায় হচ্ছে বিএনপির নাম ব্যবহার করে।
নাম না প্রকাশ করে একজন টেম্পোমালিক জানান, এই রুটে একসময় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাহেদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক জানে আলম। বৈধ ১৪৮টি টেম্পো থাকলেও তাঁরা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে অবৈধ টেম্পো চলাচল করাচ্ছেন। মালিকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। চাঁদা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়।
গত ৫ আগস্টের পর চালকদের আন্দোলনে জানে আলমকে ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে সভাপতি এখনো স্বপদে আছেন। সবশেষ ৮ জানুয়ারি দুপুরে জানে আলমের অনুসারীদের সঙ্গে স্থানীয় চালকদের সংঘর্ষ হয়। এতে এই রুটে প্রায় আধা ঘণ্টা টেম্পো চলাচল বন্ধ ছিল। পরদিন সকাল থেকে চলাচল স্বাভাবিক হয়।
মাসে ৮ লাখ টাকার বেশি চাঁদা
জানা গেছে, ১৭ নম্বর রুটে অন্তত ২০০ টেম্পো চলাচল করে; যা স্থানীয়ভাবে ‘মাহিন্দ্রা’ নামে পরিচিত। এসব টেম্পো চলাচলের জন্য মালিকদেরও ‘অনুমতি’ নিতে হয় ইউনিয়ন থেকে। তা না হলে তাঁরা টেম্পোর চাকা ফুটো করে দেন, চালকদের হুমকি দেন, মারধর করেন এবং মালিকদেরও বিভিন্নভাবে হুমকি দেন।
৯ জানুয়ারি সকালে সাতজন টেম্পোচালক ও মালিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। চালকেরা জানান, ৫ আগস্টের পর নতুন ব্রিজ (শাহ আমানত সেতু) মোড় ও কোতোয়ালি মোড়ে লাইনচার্জের নামে প্রতিদিন ১২০ টাকা নেওয়া হয়। অন্যদিকে মালিকদের কাছ থেকে মাসে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এর বাইরে নতুন টেম্পো লাইনে যুক্ত করতে ৫০ হাজার টাকা এবং পরিচয়পত্রের জন্য দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হয়।
চালক ও মালিকদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, চালকদের কাছ প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়, যা মাসে সাত লাখ টাকার বেশি। অন্যদিকে মালিকদের কাছ থেকে মাসে আদায় করা হয় বৈধ টেম্পো ৫০০ ও অবৈধ টেম্পো ১ হাজার টাকা হারে। সব মিলিয়ে এই রুটে মাসে চাঁদার পরিমাণ ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকার বেশি; বছরে যা প্রায় কোটি টাকা।
টেম্পোমালিকদের অভিযোগ, এই পুরো টাকা একসময় জাহেদ ও জানে আলম মিলে আদায় করতেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাহেদ হোসেন।
রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি
রাজনৈতিক পরিচয়ে শাহ আমানত সেতু এলাকায় ৬ থেকে ৭ বছরে এসব চাঁদাবাজি বেড়েছে বলে জানিয়েছে মালিক সমিতির নেতারা। তবে তাঁরা কার অনুসারী, তা নিয়ে বিস্তারিত জানাতে চাননি তাঁরা। চট্টগ্রাম মহানগরী অটোরিকশা অটোটেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, সেখানে অবৈধ টেম্পো নিয়ে অনেক দিন ধরেই চাঁদাবাজি হচ্ছে।
জানা গেছে, মো. জাহেদ হোসেন, জানে আলম ও বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আলী ইমাম মূলত আওয়ামী লীগ পরিচয়ে চাঁদা আদায় করতেন। বর্তমানে তাঁরা বিএনপির নাম ব্যবহার করে মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করেছেন। ৮ জানুয়ারি বিএনপির পরিচয়ে কয়েকজন এসে সড়কে টেম্পো চলাচল নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইলে সেখানে বাগ্বিতণ্ডা থেকে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
বিএনপির নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির সুযোগ নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা শওকত আলম খাজা বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমরা এ বিষয়ে সাংগঠনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
শাহ আমানত সেতু এলাকায় সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) মোহাম্মদ লিয়াকত আলী খান বলেন, অবৈধ গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদাবাজির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অপরাধ বিভাগের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হবে।