চাকরির টাকায় চলছিল না সংসার, মাটি ছাড়া চারা উৎপাদন করে স্বাবলম্বী তাওহিদ

নিজের নার্সারিতে চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার তাওহিদ মিয়া। সম্প্রতি উপজেলার মিলনপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ছিল না। শেষে সাহস করে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে ফিরে যান গ্রামের বাড়িতে। প্রশিক্ষণ নেন মাটি ছাড়া চারা উৎপাদনের। এতে বদলে যায় তাওহিদ মিয়ার ভাগ্যের চাকা। শুধু তা–ই নয়, তাঁর উদ্যোগের ফলে ১৮-২০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

তাওহিদ মিয়া রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মিলনপুর গ্রামের বাসিন্দা। এই কৃষি উদ্যোক্তার খোঁজে সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। পরে তাঁর দেখা মেলে বাড়ির পাশের একটি নার্সারিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।

তাওহিদ জানান, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি বড়। ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করেন। বাবার কিছু আবাদি জমি থাকলেও তা দিয়ে তিন বেলার খাবার জুটত না। ২০১০ সালে বিয়ের পরে সংসারের অভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে চলে যান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে কাজ নেন সোয়েটার কারখানায়। দুই বছর চাকরি করলেও সংসারের অভাব আর ঘোচে না। ২০১৩ সালে ডিসেম্বর মাসে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন বাড়িতে। পরে ২০১৪ সালের মে মাসে একটি বেসরকারি সংস্থার অধীনে মাটি ছাড়া বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদনের ওপর আট দিনের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর শুরু হয় নতুন পথচলা।

আরও পড়ুন

মাটি ছাড়া চারা উৎপাদনপদ্ধতির বিষয়ে তাওহিদ বলেন, নারকেলের ছোবড়া, গোবর, কচুরিপানাসহ প্রয়োজনীয় কিছু রাসায়নিক সার দিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখতে হয়। ক্রমান্বয়ে তা পচে গেলে শুকিয়ে গুঁড়া (কোকোপিটের গুঁড়া) করে পরিমাণমতো সেগুলো ট্রে ও গ্লাসে ভরা হয়। এরপর এতে বপন করা হয় সবজির বীজ। এক সপ্তাহের মধ্যে সেখান থেকে অঙ্কুর বের হয় এবং ২০-২২ দিন পর এসব চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে বিক্রি উপযোগী হয়।

কৃষকদের নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন তাওহিদ মিয়া
ছবি: প্রথম আলো

ওই বছরের জুন মাসে নিজের বাড়ির পাশে ১০ শতক জমির ওপর নির্মিত শেডে ট্রে বা গ্লাস ছড়িয়ে ওই পদ্ধতিতে নানা ধরনের সবজির চারা রোপণ করেন তাওহিদ। তিন মাস পর এসব বিক্রি করে তাঁর আয় হয় ৬০ হাজার টাকা। এরপর আর থেমে থাকেননি। এখন দেড় একর জমিতে একই পদ্ধতিতে মরিচ, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, পটোল, করলা, ঝিঙে, পেঁপে, টমেটো, শসা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, চালকুমড়াসহ বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করছেন। এতে খরচ বাদে মাসে গড়ে ৮০ হাজার ও বছরে তাঁর আয় হচ্ছে ৯ লাখ টাকা। এ টাকায় তিনি নিজের আবাদি জমি কিনেছেন। আছে গাভি-ছাগলও। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে খেয়েপরে আয়েশে দিন কেটে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তাওহিদ।

আরও পড়ুন

তাওহিদের নার্সারিতে চারা কিনতে এসেছিলেন খালাশপীর গ্রামের আনছার আলী। তিনি জানান, ৩০ শতক জমিতে মরিচ আর বেগুনের চারা লাগানোর জন্য জমি প্রস্তুত করেছেন। গত বছর তাওহিদের নার্সারির চারা লাগানোর পর ভালো ফসল পেয়ে লাভ করেছেন। এর আগে মাটিতে উৎপাদন করা চারা অন্য নার্সারি থেকে কিনে ওই জমিতে রোপণ করে তেমন ভালো ফল পাননি। এ কারণে এবারও তাওহিদের নার্সারি থেকে চারা কিনতে এসেছেন।

চারা কিনতে আসা পীরগঞ্জের সাইফুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘তাওহিদ ভাইয়ের কাছ থেকে ভালো চারাসহ সব সময় কৃষি বিষয়ে পরামর্শ পাই। তার পরামর্শে জৈব সার দিয়ে সবজিও ফলাই।’

তাওহিদের কাজের প্রশংসা করে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহজাহান সরদার বলেন, মাটি ছাড়া চারার উৎপাদনপদ্ধতি ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি চারা মাটিবাহিত রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকায় সুস্থ ও সবল হয়। এতে মাটিতে উৎপাদিত চারার চেয়ে ফলনও অনেক বেশি হয়। কোকো পিট মাটির তুলনায় অনেক হালকা। এ কারণে চারা স্থানান্তরের সময়ে গাছের গোড়া আঘাতপ্রাপ্ত হয় না।

আরও পড়ুন