কুলফি মালাইয়ে সংসারের অভাব-অনটন দূর 

‘কুলফি বানানোর ওস্তাদ আমার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন। আমি শুধু বেচাবিক্রি করি। বাপের বাড়িত থিকি শিখি আইসি কাজ করিচে।’

কুলফি তৈরিতে ব্যস্ত আবদুল ওহাব। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন পরিবারের সদস্যরা। গত বুধবার কুমারখালী উপজেলার সদরপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

‘মাছ মাইরতি, কলার ব্যবসা কইরতি। মাঠেঘাটে কাজ কাম কইরতি। সংসারে অভাব-অনটন ছিল। বাপ-চাচারা সবাই এলাকায় কুলফির ব্যবসা কইরতি। তাদের দেইখি শিখি ফেলিছিলাম। স্বামীর বাড়িত আসার পর সেই শিখা কাজে লাগাইছি। স্বামীক শিখাইছিলাম। এখন আস্তে আস্তে সংসারে উন্নতি করছি।’

কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর গ্রামের সদরপুর গ্রামের বাসিন্দা আম্বিয়া খাতুন। তাঁর স্বামীর নাম আবদুল ওহাব। ওহাবের বয়স ৬২ বছর। তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে কুলফি মালাই তৈরি ও নিজে ফেরি করে বিক্রি করেন।

সংসারে সুদিন আসার বিষয়ে আবদুল ওহাব তাঁর পুরো কৃতিত্ব স্ত্রী আম্বিয়াকে দিলেন। বললেন,‘কুলফি বানানোর ওস্তাদ আমার স্ত্রী। আমি শুধু বেচাবিক্রি করি। বাপের বাড়িত থিকি শিখি আইসি কাজ করিচে।’

কুলফি তৈরি দেখতে সম্প্রতি যাওয়া হয় সদরপুর গ্রামে। খুব সকালেই কুলফি মালাই ছাঁচে ভরে মুখ আটকানো হয়। গ্রামে প্রবেশ করে ওহাবের নাম করতে জানা গেল, বেশ কয়েকজন ওহাব রয়েছে গ্রামে। তবে কুলফি ওহাবের নামডাক সবার চেনাজানা।

আধা পাকা বাড়ির ভেতর ও বাইরে পরিপাটি রং করা। বাড়িতে রয়েছে সাতটি গরু ও পাঁচটি ছাগল। মাঠে রয়েছে বিঘা দুই জমি। চার মেয়ে, এক ছেলের সংসারে তিন মেয়ে ও ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। সবই করেছেন কুলফি বিক্রির টাকায়।

১৫ বছর আগেও খড়ের ঘর ছিল। ছিল পাটকাটির বেড়া। জায়গাজমিও ছিল না জানিয়ে আবদুল ওহাব বললেন,‘এখন আমি খুবই ভালো আছি। প্রতিদিন ফেরি করে কুলফি বিক্রি করি। ফরমায়েশও পাই।’

সকাল সাতটায় ছাঁচে কুলফি ভরার আগে কড়াভর্তি দুধ ঘরের বারান্দায় নিয়ে আসেন ওহাব। জানালেন, কুলফি তৈরির জন্য গরুর দুধ এলাকা থেকেই কেনেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুধ জ্বালাতে থাকেন। গাঢ় হয়ে গেলে সন্ধ্যার পর সেই দুধ কড়াইয়ে করে ঘরের ভেতর রাখেন। সারা রাত ঠান্ডা হলে পরের দিন সকালে তার ভেতর চিনি মেশান।

প্রতি এক মণ জ্বালানো দুধে দুই কেজি চিনি মেশান। এরপর স্বাদ ঠিক আছে কি না, সেটা দেখে দেন। এতে সহযোগিতা করেন ছেলের বউ সীমা খাতুন। মুখে দিয়েই বললেন,‘আব্বা, ঠিক হয়াচে।’

ছাঁচে কুলফি ভরা হয়ে গেলে স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন আটা ও চুন দিয়ে তৈরি একধরনের আঠা দিয়ে ছাঁচের মুখটা ভালো করে আটকে দিচ্ছেন। তাতে সহযোগিতা করছিলেন ওহাবের বোন মনোয়ারা বেগম।

এক মণ দুধে ১০ থেকে ১২ কেজি মালাই হয়। ছাঁচ রয়েছে ৩০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। মালাই–ভর্তি ছাঁচগুলো হাঁড়িতে করে পার্শ্ববর্তী আলাউদ্দিননগরে নিয়ে যান। সেখানে বরফ কল থেকে বরফ কিনে হাঁড়ির ভেতর নিয়ে মালাই ঠান্ডা করেন। কয়েক ঘণ্টা পর সেগুলো নিয়ে সৈয়দ মাছ উদ রুমী সেতুর পাশে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেন।

গরমকালে সবচেয়ে বেশি কুলফি বিক্রি হয় জানিয়ে ওহাব বললেন, এই সময়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার কুলফি বিক্রি করেন। ঠান্ডা পড়ছে, তাই বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ফরমাশ পান। তৈরি করে সেসব জায়গায় কুলফি পাঠান।

ছেলে রাকিবুল ইসলাম বললেন, এলাকা থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। কুলফি বেচা বিক্রিতে সহযোগিতা করা হয়। বিশেষ করে অর্ডার নেওয়া কুলফি শহরে পৌঁছে দেওয়া হয়। কুলফির মান ভালো রাখা হয় বলে চাহিদাও বেড়েছে।