খুব সাধারণ বাজারটি পরিচিতি পেয়েছে ‘রাশেদের খাসির নলার হালিমের’ কারণে

দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন রাশেদের খাসির নলার হালিম খেতে। সম্প্রতি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার থুকড়া বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থুকড়া। খুলনা শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। গ্রামের বাজারটির নামও থুকড়া। স্থানীয় লোকজনই সেখানকার ক্রেতা-বিক্রেতা। ডুমুরিয়া উপজেলার খুব সাধারণ বাজারটি হঠাৎ বেশ পরিচিতি পেয়েছে এক হালিম বিক্রেতার কারণে। প্রতিদিন বিকেল হলেই ‘রাশেদের খাসির নলার হালিম’ খেতে ছুটে আসেন দূরদূরান্তের ভোজনরসিকেরা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার বাটি হালিম বিক্রি হয়। ছুটির দিনে সংখ্যা আরও বাড়ে। খুলনা শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ এ হালিমের প্রধান ক্রেতা। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে হালিম বিক্রি শুরু করেন, বেশির ভাগ দিন রাত আটটার মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়। রাত আটটার পর এলে ভাগ্য সহায় না হলে ওই হালিমের স্বাদ না নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় ক্রেতাকে।

এই হালিম বিক্রেতার পুরো নাম রাশেদ গাজী। বাড়ি থুকড়া বাজারের পাশেই। তাঁর হালিমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো চুইঝাল, রসুন ও খাসির মাংস। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে দেওয়া হয় খাসির নলা। এ হালিমই বদলে দিয়েছে রাশেদের জীবনও।

রাশেদের হালিমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো চুইঝাল, রসুন ও খাসির মাংস
ছবি: প্রথম আলো

রাশেদ জানান, তাঁর মূল ব্যবসা ছিল ঘুগনি ও ঝালমুড়ি বিক্রি। সেটা শুরু করেন ২০১৪ সালের দিকে। চুইঝাল ও রসুন দিয়ে ওই ঘুগনি ও ঝালমুড়ি তৈরি করতেন, কিন্তু তা তেমন লাভজনক ছিল না। ২০২০ সালের শুরুর দিকে পাশের এক বিক্রেতা ঘুগনির পাশাপাশি হালিম বিক্রি শুরু করেন। তা দেখে ওই বছরের শেষের দিকে রাশেদও হালিম বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে কীভাবে আরও মজাদার ও সুস্বাদু করা যায়, সে বিষয়ের দিকেই নজর ছিল তাঁর। প্রথম দিকে নিজ হাতে হালিম রান্না করতেন। চুইঝাল, রসুন, রকমারি মসলা ও হালিমে মাংসের আধিক্য ভোক্তাদের কাছে অন্য রকম মাত্রা দেয়। রাতারাতি তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরে। বিভিন্ন ফুড ভ্লগাররা তাঁর হালিম নিয়ে রিভিউ দেওয়া শুরু করেন। এখন খুলনার মধ্যে ভালো হালিম বলতে রাশেদের হালিমকেই বোঝান সবাই।

গত শনিবার বিকেলে থুকড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারটি বেশ ছোট। চারপাশে বিভিন্ন দোকান, মধ্যখানে ইট বিছানো উন্মুক্ত চাতাল। সেই চাতালে বিভিন্ন সবজির পসরা সাজিয়েছেন জনাবিশেক সবজি বিক্রেতা। চাতালের মাঝবরাবর পাশাপাশি কাচ দিয়ে মোড়ানো দুটি ভ্যান। ভ্যানের ওপরের অংশে লেখা ‘রাশেদের ঘুগনি এন্ড খাসির হালিম’। ভ্যানের সামনের অংশে রাখা হালিমের ডেগ। নিজেই হালিম বাটিতে ভরে সবাইকে পরিবেশন করছেন রাশেদ। কথা বলার ফুসরত নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে হাসিমুখে কথা বলছেন। হালিম খাওয়ার আগে বা পরে হালিমের ও রাশেদের সঙ্গে ছবি তুলছেন বেশির ভাগ মানুষ। কোনো কিছুতেই বিরক্তি নেই রাশেদের।

হালিমের পাশাপাশি ঘুগনি ও ঝালমুড়ি বিক্রি করেন রাশেদ
ছবি: প্রথম আলো

রাশেদের হালিম খেতে এসেছিলেন খুলনা নগরের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজের প্রভাষক এস এম সোহেল ইসহাক। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যেই রাশেদের হালিম খেতে আসি। খুবই স্বাদ। খুলনা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। তবে ওই হালিম খেলে দূরত্বের ক্লান্তি আর থাকে না। মাংসের পরিমাণ বেশি, স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ কারণেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসে।’

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রাশেদ গাজী। বর্তমানে বয়স ৩৪ বছর। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং মাকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার তাঁর। ছেলে নবম শ্রেণিতে ও মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা আলতাফ গাজী ছিলেন দিনমজুর। আর্থিক সংকটের কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি রাশেদ। এক মুদিদোকানের কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ২০১৪ সালে ঘুগনি বিক্রির কাজ শুরু করেন। তবে হালিম বিক্রি বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন। এখনো হালিমের পাশাপাশি ঘুগনি ও ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি।

রাশেদ গাজী বলেন, প্রথম দিকে পাঁচ থেকে আট কেজি হালিম রান্না করতেন। যত ধরনের স্বাদের উপকরণ আছে, তা মেশানোর চেষ্টা করেন। এতে খরচ বেশি ও লাভ কম হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা বেশ গ্রহণযোগ্য হয়। দিন দিন ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এখন তাঁর ক্রেতার ৬০ শতাংশেরও বেশি আসেন খুলনা শহর থেকে। অন্যরা আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম, সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চল থেকে আসেন।

রাশেদ আগে সবকিছু নিজ হাতে করতেন, এখন এসব কাজ শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে। তিনি বাইরের বিভিন্ন মালামাল জোগাড় করায় ব্যস্ত থাকেন। রাশেদ বলেন, ‘যে কাজই করি, মন দিয়ে করার চেষ্টা করি। এ কারণেই তা কিছুটা ভিন্ন হয়। আর মানুষের কাছে ভিন্ন স্বাদ থাকার কারণেই মানুষ তা গ্রহণ করেছে।’