যে বিদ্যালয়ে নেই কোনো শিক্ষার্থী
বিদ্যালয়ের একতলা ভবনের সামনে কয়েক ফুট লম্বা ঘাস ও আগাছা। নামফলকে পড়েছে কাদামাটির আস্তরণ। পাশের পুরোনো তিনতলা ভবনটিও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। শিক্ষার্থীদের আনাগোনা না থাকায় খেলার মাঠটিও ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের সমুদ্রতীরবর্তী পতেঙ্গা এলাকার লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি।
একসময় বিদ্যালয়ের দুই ভবনজুড়ে শিক্ষার্থীদের শোরগোল আর মাঠে খেলাধুলার আমেজ ছিল। বর্তমানে সেসব কিছুই নেই। দুই বছর ধরে বিদ্যালয়ে আনাগোনা নেই কোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর। ফলে জনশূন্য হয়ে পড়ে আছে পুরো বিদ্যালয় এলাকা। ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করার প্রক্রিয়াও চলছে।
জানা গেছে, লালদিয়ার চর এলাকাটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। ২০২১ সালের চরের অবৈধ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকে শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিদ্যালয়ে চলে গেছে। বর্তমান বিদ্যালয়টির দুটি ভবনই ফাঁকা। পুরোনো ভবনটি জরাজীর্ণ। বিশাল খেলার মাঠও আর নেই। ছয়জন শিক্ষকের চারজন বদলি হয়ে গেছেন। একজনের বদলির আদেশ হয়েছে। তবে এখনো দায়িত্বে আছেন প্রধান শিক্ষক।
১৯৭২ সালে জহুরুল হক বিমানঘাঁটি সম্প্রসারণের সময় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পতেঙ্গার ‘নিষ্কণ্টক জমি’র পরিবর্তে লালদিয়ার চরে জায়গা দেওয়া হয়েছিল শতাধিক পরিবারকে। সে সময় প্রায় শূন্য দশমিক ৯২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছিল লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যদিও এর আগে বিমানবন্দর এলাকায় অস্থায়ীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। সে সময় এটি বেসরকারি ছিল।
বন্দর থানা শিক্ষা দপ্তর জানায়, ১৯৭২ সালের পর প্রতিবছরই শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে। লালদিয়ার চরের প্রায় আড়াই হাজার পরিবারের শিশুরা এই বিদ্যালয়েই পড়ালেখা করত। একসময় প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ শিক্ষার্থী ছিল বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ায় ২০১১-১২ সালে বিদ্যালয়ের নতুন ভবনটি করা হয়। উচ্ছেদের পর সবশেষ ২০২২ সালে ৬০ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। ২০২৩ থেকে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ।
সরেজমিনে দেখা যায়, জনমানবহীন হয়ে পড়ে আছে দুটি ভবন। একতলা ভবনটির সামনে খেলার মাঠটি ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে। বিদ্যালয়ের সামনে থাকা শহীদ মিনারটিও ঢাকা পড়েছে আগাছার পেছনে। স্থানীয় লোকজন জানান, বিদ্যালয় ভবনগুলোতে এখন কেউ আসে না। পাহারার জন্য আনসার সদস্যরা থাকেন এখানে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবলী বিশ্বাস বর্তমানে চট্টগ্রাম পিটিআই–সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে সংযুক্ত রয়েছেন। প্রায় চার বছর ধরে তিনি লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালের পর শিক্ষার্থী সংখ্যা কমতে থাকে। শিক্ষকদেরও অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সরঞ্জামও অন্য বিদ্যালয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়টি নগরের দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে অবস্থিত। বন্দর শিক্ষা থানার আওতায় ৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে রয়েছে ৯টি। যেখানে প্রায় ২ হাজার ৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। লালদিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে চার-পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় আরও তিনটি বিদ্যালয় রয়েছে। বাসিন্দারা অন্যান্য এলাকায় চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা সেখানে চলে গেছে।
বন্দর থানা শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেষ্টা করেছিলাম আশপাশের কোনো স্থানে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করার। তবে সেটি সম্ভব হয়নি। আশপাশে তেমন বাসিন্দা নেই। শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিদ্যালয়ে চলে গেছে। বিদ্যালয়টি বিলুপ্ত ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।’
গত জুন মাসে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষার্থী না থাকার কারণে বিদ্যালয়টি বিলুপ্ত ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে। ভবন, আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রীর বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।